রওশন আরা পারভেজ
প্রভাষক
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা
অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসএ্যাবিলিটিজ বিষয়ক মাস্টার ট্রেইনার এবং
প্রাথমিক মনোবৈজ্ঞানিক সেবা প্রদান বিষয়ক মাস্টার ট্রেইনার।
‘ফ্যাশন’ তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাপক। বেশিরভাগ মানুষ স্টাইল এবং ফ্যাশনকে একই বিষয় মনে করেন। বাস্তবে দুটো বিষয়ের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। স্টাইল বলতে একজন ব্যক্তির নিজস্ব রুচিবোধ বা ডিজাইনকে বোঝানো হয়ে থাকে। অপরদিকে ফ্যাশন বলতে স্টাইল, পরিবর্তনশীলতা এবং গ্রহনযোগ্যতার সম্মিলিত মিশ্রণকে বোঝায়। সহজভাবে বলতে গেলে, একজন ব্যক্তি কী টাইপের পোশাক পড়বে, তার চুল বড়ো নাকি ছোট থাকবে সেটা হচ্ছে স্টাইল। একটা সময় ছিল যখন শর্ট কামিজ পড়াকে স্মার্ট হিসেবে গন্য করা হত। কারণ ওই সময়ের ফ্যাশন ছিল শর্ট কামিজ। এটাকে ফ্যাশন বলা হচ্ছে কেননা ফ্যাশন যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে প্রবর্তিত হয় যা সমাজে গ্রহণীয় ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। মূলত পোশাকের সাথে ফ্যাশন শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পোশাকে নতুন নতুন ডিজাইন আনয়ন করে ফ্যাশনে পরিণত হয়।
ফ্যাশনের গুরুত্ব:
১. ফ্যাশনের মাধ্যমে একটি সমাজের মূল্যবোধ, কৃষ্টি ও প্রথা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়
২. নিজস্ব সংস্কৃতিকে অপরের নিকট প্রকাশ করা যায়
৩. নিজেকে অন্যের নিকট আকর্ষণীয় বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হিসেবে তুলে ধরা যায়
৪. পোশাকে বৈচিত্র্য আনয়ন করা যায়
৫. পোশাকে আধুনিকতার ছেঁায়া আনয়ন করা যায়
৬. ফ্যাশনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির রুচিবোধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়
৭. পোশাকের একঘেয়েমি দূর করা যায়
মনের সাথে ফ্যাশনের সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষের মন বড় বিচিত্র আর এই বৈচিত্র্যতা আরো সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে তার ফ্যাশন চর্চার মধ্য দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে মূল্যবোধ আমাদের ফ্যাশন চর্চাকে প্রভাবিত করে থাকে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, কৃষ্টি ও প্রথা দ্বারা সবসময়ই ফ্যাশন প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন— ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন দেশগুলোতে পর্দার বিষয়টি মাথায় রেখেই ফ্যাশন প্রচলিত ও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আবার অসাম্প্রদায়িক দেশগুলোতে যার যার উৎসব, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ মাথায় রেখেই ফ্যাশন চর্চা করা হয়। ফ্যাশনের সাথে যেহেতু পোশাকের নিগূড় সম্পর্ক রয়েছে তাই বলা যায় শুধু প্রয়োজন মেটাতেই মানুষ পোশাক পড়ে না। এর পেছনে রয়েছে ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি, মূল্যবোধ ও কৃষ্টিসহ আরো অনেক বিষয়। একজন তরুণ বা তরুণী নিজেদেরকে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে অনেক সময় বিদেশি মডেল বা সেলিব্রেটিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। সবাই এদেরকে ফ্যাশন সচেতন হিসেবে বেশ বাহবা দিতে থাকে। কিন্তু ফ্যাশন শব্দটি শুধু পোশাকের বৈচিত্র্যতা বোঝাতেই ব্যবহৃত হয় না। ফ্যাশন বলতে একজন ব্যক্তির সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারাকে বোঝায়, যেকোনো নতুন কিছুকে গ্রহণ কেও নেয়া বোঝায়। কেউ যদি প্রচলিত ট্রেন্ড বা প্রথার সাথে তাল মেলাতে না পারে তাহলে তা ব্যক্তির মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেকে লুজার ভাবতে পারে যা তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা বা আত্মবিশ^াসকে নষ্ট করে দিতে পারে। আবার এর উল্টোটাও ঘটতে দেখা যায়। কেউ কেউ বিদেশি ট্রেন্ড অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি অর্থাৎ শেকড় ভুলে যায় যা তার পরিবার থেকে শুরু করে আশেপাশের অন্যদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে মনের ওপর ফ্যাশনের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
ইতিবাচক প্রভাব:
১. নতুন পোশাক পরিধান করলে অনেক সময় আত্মবিশ^াস বেড়ে যায়, মুড ভালো থাকে
২. নিত্য নতুন ফ্যাশনের পরিবর্তনের কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়
৩. ফ্যাশনের নতুন ধারা একজন ব্যক্তিকে সাধারণ থেকে স্পেশাল ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে
৪. অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বুঝতেও সাহায্য করে
৫. বিভিন্ন ধরনের কৃষ্টি এবং ট্রাডিশন সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হয়
নেতিবাচক প্রভাব:
৬. মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফ্যাশন প্রবণতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণে ঐতিহ্যবাহী নকশা ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে
৭. তরুণ প্রজন্ম নিজের সংস্কৃতির চেয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছে যা তাদের মূল্যবোধ ও মনোভাবে প্রভাব ফেলছে
৮. এই ধরনের নতুন ফ্যাশন প্রবণতা তরুণদের মনের ওপরেও বেশ প্রভাব ফেলছে। তাই তারা যদি এটি না পায় তা তাদের মনকে খারাপভাবে প্রভাবিত করে থাকে। ফলশ্রম্নতিতে খাওয়ার ব্যধি, মানসিক অসুস্থতা, চাপ, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদির মতো মানসিক রোগের শিকার হচ্ছে।
এটি নিঃসন্দেহে সত্য যে, আজকের প্রজন্ম পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে দেখতে চায় — যেটাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু নিজেকে আধুনিক বানাতে গিয়ে যদি নীতি—নৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয় তখন সেটা ভুল।
সুতরাং এটি নির্ভর করছে ব্যক্তির ওপরÑ সে কিভাবে নিজেকে তৈরি করতে চায় এবং দেখতে চায়। সবশেষে বলতে চাই ব্যক্তির মনের ওপরই নিজেদের ফ্যাশন চর্চা, স্টাইল প্রভৃতি বিষয় নির্ভর করে।