হাসপাতালের বিছানায় নির্বাক শুয়ে আছেন পঁয়তাল্লিশ বছরের জাহান বেগম। ধীরে ধীরে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হলে বিড়বিড় করে একটা কথাই উনাকে বলতে শোনা যায়, ‘মেয়েটা কী বলতে চেয়েছিল, ও বাঁচতে চেয়েছিল, কেন আমি পারলাম না বাঁচাতে’। এক মাস আগে তার সতেরো বছরের মেয়ে আত্মহত্যা করে।
প্রথম কিছুিদন যেন বুঝেই ওঠার সুযোগ হয়নি, থানা-পুলিশ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সকলের প্রশ্ন, কৌতহূল, সহানুভূতিতে মোড়ানো একরকম যেন বিদ্রুপ মেশানো করুণা এসব পার করে বিছানায় পড়লেন। তারপর থেকে খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা বন্ধ, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘমুাতে পারেন না। মাঝে মাঝে শ্বাস আটকে আসে যেন, আর যেন অনুভব করতে পারেন যে মেয়েটা মত্যুর আগে কত কষ্ট পেয়েছিল। তার আরো দইু সন্তান, স্বামীর জীবনও থমকে গেছে।
সকল মত্যুই বেদনার। কিন্তু প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মত্যু ওলটপালট করে দেয় জীবন। স্বাভাবিক মত্যু তথা বৃদ্ধ বয়সে অথবা র্দীঘদিন অসুস্থতায় ভুগে মত্যুর ক্ষেত্রে আপনজনেরা অনেকটাই যেন তৈরি থাকেন, শেষ বিদায় জানাতে পারেন, আবেগ অনুভূতির টানাপোড়েনগুলো আলোচনা করে নিতে পারেন-শোক থাকলেও সেটার ভার বহন সম্ভব হয়। কিন্তু অস্বাভাবিক মত্যু তথা দুর্ঘটনা, মহামারী, হত্যা বা আত্মহত্যায় মত্যৃুর ক্ষেত্রে শোক হয়ে ওঠে জটিল। এই মত্যুগুলোতে মৃতদের শেষ মুহূর্তের কষ্টের এক ধরনের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে আপনজনদের মনে। ‘কতটা কষ্ট পেয়েছিল’, ‘কী বলতে চেয়েছিল’, ‘বাচঁতে চেয়েছিল কীভাবে’-এরকম প্রশ্ন এবং সেইসঙ্গে অনুভবগুলোও তাড়া করতে থাকে।
শেষ সময়ের স্মৃতিচারণ করতে না চাইলেও বারবার বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মখুীন হতে হয়। পুলিশ, সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী, আদালত, পরিচিতজনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়; মৃত্যুর ঘটনা, বিভিন্ন স্মৃতির পুনরাবৃত্তি করতে হয়। শোকের সঙ্গে যোগ হয় এমন কিছু প্রশ্নের যেটার উত্তর হাজারবার খুঁড়েও পাওয়া সম্ভব হয় না, এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা মনকে গ্রাস করে।
এইরকম শোকের আরেকটি দিক হচ্ছে হারানোর বেদনা। স্বাভাবিক মত্যুতে এরকম থাকলেও অস্বাভাবিক মত্যুতে বিদায় না দেয়ার আক্ষেপ, হঠাৎ আসা অনিশ্চয়তা কাজ করে। প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, হত্যা,মহামারী সরাসরি দেখা বা ঘটনা শোনার পর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হতে পারে। এছাড়াও শোকস্তব্ধ ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতা রোগ দেখা দিতে পারে।
বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে শোকতপ্ত ব্যক্তি, পরিবারকে সাহায্য করতে পারে পরিবারের সদস্যরা। একে অপরকে ভরসা দেয়া, বাস্তবিক সাহায্য করা, আবেগ প্রকাশের নির্ভরযোগ্য স্থান হয়ে উঠতে পারে পরিবার। এছাড়াও পরিচিতজন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল আচরণ এসব ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজন। যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে একেবারেই ফেরত আসতে না পারেন শোকগ্রস্ত ব্যক্তি, খাওয়াদাওয়া-ঘুম ব্যাহত হয়ে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয় তাহলে শারীরিক এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন হয়।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
ধন্যবাদ