আমাদের মহান সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’’ কিন্তু বাস্তবে কি তা মানা হয়? বৈষম্য… সেটা নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো যে রূপেই আসুক না কেন… চলছেই সেটা সেই আদিকাল থেকে। বর্তমান পুঁজিবাদী এ বিশ্বে যেখানে সমতাই হওয়া উচিত একমাত্র লক্ষ্য, সেখানে এই বৈষম্য চিন্তার বিষয় বৈকি! পেশাগত বৈষম্য এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে একজন ব্যক্তির বয়স, অক্ষমতা, জাতিগত, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, জাতীয় উৎপত্তি, জাতি, ধর্ম বা যৌন অভিমুখের কারণে অন্যায় আচরণ করা হয়। পেশাগত বৈষম্যের একটি কঠিন রূপ হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মানসিক রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আর এতে সৃষ্ট কাজের চাপে কর্মীরা বিষণ্ণতাসহ নানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম পারিশ্রমিক, কর্মী ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে মূলত কর্মীরা বিষণ্ণতায় ভোগেন।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্ণতার কারণে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কাজে মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মনে রাখার সমস্যায় ভোগেন। এতে একজনের গড়ে বছরে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ম অনুসারে একজন কর্মীর কাজের সময় ৮ ঘণ্টা হলেও বাস্তবে এর চেয়ে বেশি সময় অফিস করতে হয়। কখনো কখনো কোনো প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত চাপ নেবার বিষয়টিকে তার দক্ষতা ভেবে কর্মীর ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত চাপ একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা তার কর্মোৎপাদনশীলতা এবং স্পৃহাকে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করতে পারে। তাছাড়া নারী কর্মীদের প্রতি যৌন হয়রানি, গর্ভকালীন বা গর্ভ-পরবর্তী সুযোগ-সুবিধার অভাব পেশাগত জীবনে অনেক নারীর জীবনকে বিষিয়ে তুলে। এতে নারীরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে, চাকুরিতে অনীহা, এমনকি চাকুরিতে পারিবারিক বাধার ও সম্মুখীন হয়।
কর্মক্ষেত্রে বুলিং, বডি-শেমিংয়ের মতো অপরাধগুলোও এখন অনেকটাই সাধারণ বিষয়। সহকর্মীদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হলে একজন কর্মীর মনোজগতে এক মারাত্মক পরিবর্তন আসতে পারে। সে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, অন্যদের সাথে মিশতে পারে না, কর্মউদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। ফলে সে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে নিজের জীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
তাছাড়া অনেক কর্মীদের ক্ষেত্রে চাপ নেয়ার ক্ষমতা, খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতাও অন্যদের চেয়ে কম থাকে। পেশাগত বা কাজের বা অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে সে যখন ম্যানেজ করতে পারে না, তখন তিনি বিষণ্ণতা বা উদ্বেগে আক্রান্ত হন। পেশাগত বা কর্মজীবনে বৈষম্যের এই যে মানসিক চাপ, সেটার কি সমাধান নেই? আসলে যেখানে মৌলিক চাহিদা পালনে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, সেখানে মানসিক সুস্থতা নিয়ে ভাববার সময় কোথায় মানুষের! তারপরও পেশাগত বৈষম্য রোধে আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে সরকার। বেশ কিছু দেশি-বিদেশি সংগঠন উচ্চকিত এ ব্যাপারে, বিশেষ করে জেন্ডার বৈষম্য রোধে বেশ কিছু প্রস্তাবনা আসছে। এই বৈষম্য সমাধানের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে:
কর্মস্থলে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগদান করতে হবে। কারো মানসিক রোগ থাকলে শুধু এ কারণে তাকে নিয়োগ দেওয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। কোনো কর্মীর শারীরিক ও মানসিক কোনো অসুস্থতা থাকলে তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ও পূর্বঘোষিত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। মানসিক রোগ নিয়ে কর্মস্থলে সহকর্মীকে কটাক্ষ করার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছ নীতিমালা থাকতে হবে। কর্মস্থলে পরিবেশ এমন হতে হবে যেন তা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। মহিলা কর্মীদের যৌন হয়রানি রোধে সেল গঠন করা এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
কর্মীদের মানসিক চাপ কমাতে কর্মক্ষেত্রে কাউন্সিলিং সেবার ব্যবস্থাও রাখা উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক কর্মীরই কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত, যেমন-কর্মক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত পার্থক্যকে সম্মান করা। আচরণ এবং বক্তৃতায় পেশাদার হওয়া। বৈষম্য এবং হয়রানি শুরু করতে, অংশগ্রহণ করতে বা সমর্থন করতে অস্বীকার করা। জাতিভিত্তিক বা সাংস্কৃতিকভাবে আক্রমণাত্মক হাস্যরস বা কৌতুক এড়িয়ে চলা উচিত।
করোনাকালীন এই অসম পৃথিবীতে যেখানে নূন্যতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করে জীবন ধারণ করাটাই মূখ্য হয়ে উঠেছে, সেখানে পেশাগত বৈষম্যের কারণে মানসিক চাপ যেকোনো মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। তাই আমরা সদয় হই। নিজের সহকর্মীর জীবনকে কর্মক্ষেত্রে কঠিন না করে তার কষ্টের বা আনন্দের অংশীদার হই।
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে