আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের আয়োজনে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী

0
11

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা আহছানিয়া মিশন এক আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। গত ২ মার্চ, রবিবার, বিকাল ৩:৩০ মিনিটে ধানমন্ডির (বাড়ি-১৯, সড়ক-১২) আহছানিয়া মিশনের প্রধান কার্যালয়ের মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব ফরিদা আখতার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জনাব মাহফুজা রহমান চৌধুরী বাবলী এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইয়াসমিন এইচ আহমেদ।

আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের কাউন্সেলিং সার্ভিসের কো-অর্ডিনেটর ড. রাহেনা বেগম এবং স্বাস্থ্য সেক্টরের সহকারী পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) ডা. নায়লা পারভীন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান।

নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বক্তারা নারীর উন্নয়ন ও সমাজে তাদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্বারোপ করে বিশেষ বক্তব্য রাখেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস। তার বক্তব্য নিচে হুবুহু তুলে ধরা হলো-

মঞ্চে উপবিষ্ট আমাদের সকলের সম্মানিত প্রধান অতিথি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা জনাব ফরিদা আখতার ম্যাডাম, বিশেষ অতিথি – এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জনাব মাহফুজুর রহমান চৌধুরী বাবলি ম্যাডাম ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: ইয়াসমিন এইচ আহমেদ ম্যাডাম এবং আমাদের আরো রয়েছেন ঢাকা আহসানিয়া মিশনের কাউন্সিলিং সার্ভিস এর কো-অরডিনেটর ড. রাহেনা বেগম ম্যাডাম এবং ঢাকা আহসানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সহকারি পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) ডা: নায়লা পারভিন ম্যাডাম এবং অনুষ্ঠানের সভাপতি ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড .গোলাম রহমান স্যার এবং পরিচালক জনাব ইকবাল মাসুদ স্যার, এবং উপস্থিত সম্মানিত সকল অতিথিবৃন্দ আসসালামু আলাইকুম। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে আমরা একত্রিত হয়েছি নারীর অধিকার ,সমতা ,ক্ষমতায়ন ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে।

বেগম রোকেয়া বলেছেন- ” যে জাতি নারীকে অবজ্ঞা করে সে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।”

বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন,” We cannot all succeed when half of us are held back.” – অর্থাৎ আমরা সবাই সফল হতে পারবো না, যদি আমাদের অর্ধেককে পিছিয়ে রাখা হয়।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো – “অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন –  নারী ও কন্যার উন্নয়ন।” এ দিনটি শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং নারীদের জীবনমান উন্নত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও সময়।

নারী দিবসের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটে আলোকপাত করি-

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা ১৯০৮ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পনের হাজার নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে ন্যায্য মজুরি ,কর্ম ঘন্টা কমানো এবং ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এরপর ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি “জাতীয় নারী দিবস “পালন করে। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, যেখানে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯১১ সালে প্রথমবার অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ,জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ (ইউএনও) এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৭ সালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী অধিকার ও সমতার লক্ষ্যে এই দিনটি পালনের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি শুধু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন নয় ,বরং নারীদের অধিকার রক্ষা , সমান সুযোগ তৈরি ,লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ফিরে আসি। এবারের প্রতিপাদ্য হলো- “অধিকার, সমতা ,ক্ষমতায়ন- সকল নারী ও কন্যার উন্নয়ন।” এ নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে পুরো সমাজের কাছে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন ,কিন্তু অর্থপূর্ণ প্রশ্ন আমি ছুঁড়ে দিতে চাই। আমাদের গুরুজনেরা ,মনীষী -মহীয়সীরা সত্যিই অনেক সুন্দর কথা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন যদিও-

  • তবুও আমরা এখনো কেন লড়াই করেই যাচ্ছি?
  • এখনো শত শত মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত। কেন?
  • এখনো কেন তাদের পাতে মাছের লেজটাই নিয়ম করে জোটে?
  • এখনো কেন পাবলিক প্লেসে হেনস্থার শিকার হতে হয়?
  • এখনো মার্জিত ভাবে চললেও নোংরা দৃষ্টির ছোবলে সর্বদা কুঁচকে থাকতে হয়। কেন?
  • নারী প্রতিষ্ঠিত হলেও শুনতে হয় -“ও নিশ্চয়ই কুপথে রোজগার করে “।কেন?
  • এখনো নারী কেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে?
  • এখনো নারী সমাজের বেশির ভাগই বিষণ্ণতার রোগী ।কেন?
  • এখনো নারী “কোনটা তোমার আসল বাড়ি”- এই প্রশ্নে ঘোরপাক খায়?
  • এখনো নারী মানেই রান্নাঘর ।কেন?
  • এখনো নারী- ” কে আমার আপন”- খুঁজতে খুঁজতে হয়রান?
  • এখনো কেন পরিবারের কোনো সিদ্ধান্তের বৈঠকে ঠাঁয় হয় না? সিদ্ধান্ত দেয়ার কন্ঠ দিতে পারেনা? অধিকার তার নেই -কেন?
  • এখনো নারী টক্সিক ম্যারাইটাল লাইফেও আতঙ্কগ্রস্ত, আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্কগ্রস্থ?

বিয়ের পর আতঙ্ক, স্বামী যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়!

আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্ক ,সমাজ যদি আমাকেই দোষারোপ করে যে, আমিই খারাপ তাই সংসার টেকাতে পারিনি?

  • সব ক্ষেত্রেই এখনো কেন নারীর দোষ?
  • শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের পদে পদে বাঁধা ।কেন?
  • কেন বেতন বৈষম্য?
  • কেন চাকরির সুযোগের অভাব?
  • পারিবারিক ও সামাজিক গোঁড়ামী -কেন?
  • মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন -কেন?

আমার এ প্রশ্নগুলোর বাইরেও হাজার হাজার প্রশ্ন নিয়ে আজও আমাদের নারীসমাজ যুদ্ধ করছে ।এই যুদ্ধের অবসান এখন সময়ের দাবি।

অথচ দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, নারী কোন একক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নন- তিনি একাধারে মা, মেয়ে ,স্ত্রী ,বোন, কর্মী ,নেতা ,চিকিৎসক ,ব্যবসায়ী ,ইঞ্জিনিয়ার ,খেলোয়াড় ,স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। শিক্ষা ,বিজ্ঞান ,চিকিৎসা ,রাজনীতি, ব্যবসা ,ক্রীড়া সবক্ষেত্রে নারীরা সফলতার গল্প লিখেছেন। বেগম রোকেয়া থেকে মালালা ইউসুফজাই, মেরি কুরি থেকে কাল্পনা চাওলা- তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে ,নারী এগিয়ে গেলে সমাজও এগিয়ে যায়।

বিশ্বখ্যাত লেখিকা মায়া এঞ্জেলু বলেছেন-” Each time a woman stands up for herself, she stands up for all women.”অর্থাৎ ,প্রতিবার একজন নারী যখন নিজের জন্য দাঁড়ায়, তখন তিনি সকল নারীর জন্যেও দাঁড়ায় ।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,” বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর ,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন তার “আমি নারী “কবিতায়-

“আমি সেই নারী-

যে জগতের আলো আঁধারে আপন শক্তিতে জ্বলে,

আমি সেই নারী-

যে প্রেম ,সাহস ,শক্তি ,ভালোবাসায় অনড় ও অমলিন।”

নারী সমাজের ব্যাপারে আমাদের ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ (রা:), যিনি ছিলেন একজন সুবিবেচক এবং বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর দৃষ্টি এবং চিন্তাশক্তি খুবই প্রখর ও সুনিপুন ছিল সেই আমলেও। তিনি বলেছেন,”মুসলিম মহিলাগন কখনো জ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে পুরুষ দিগের পশ্চাতে ছিলেন না। এমনকি বহুবিধ শাস্ত্রে তাঁহারা অধিকতর পারদর্শী ও অগ্রণী ছিলেন। কি অস্ত্রবিদ্যায় ,কি রাজনীতি, কি রাজ্য শাসন সর্বত্রই তাঁহাদের প্রতিভা প্রকাশ লাভ করিয়াছিল।” ( রচনাবলী; তৃতীয় খন্ড; পৃষ্ঠা ৯৫ – ৯৯) ।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এখনো অনেক নারী বৈষম্যের ,নির্যাতনের ,বেতন বৈষম্য ,সুযোগ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। আজকের এই দিবসে আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি- নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দিব, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করব, নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সম্মান করব।

সকল নারীদের আমি ডা.রুবাইয়াৎ ফেরদৌস, একটা মেসেজ দিতে চাই- আসুন আমরা কোন বাধার দেয়ালে থেমে না যাই, বরং সেই দেয়াল ভেঙে নতুন পথ তৈরি করি। কারণ নারী হল শক্তি, নারী হল সাহস, নারী হলো আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা। নারী যখন নিজের শক্তি বুঝতে পারে, তখন সে পুরো বিশ্ব বদলে দিতে পারে। ঐদিন খুব তাড়াতাড়িই আসবে যেদিন সমতা, ক্ষমতা আর অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে না। ওই নতুন পথে আলোকিত হয়ে নারী-পুরুষ সকলেই হাঁটবো – দেশ ও জাতিকে উন্নত করব।

যাবার কালে কবি জীবনানন্দ দাসের সাথে কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে যাই –

” আমার ভিতরে রক্তের স্রোত আছে ,

আমার চোখে অগ্নিশিখা

আমি থামবো না

আমি হারবো না।”

ধন্যবাদ।

নারী সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য পুরস্কার বিতরনীর মাধ্যামে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

Previous articleআমাকে কোনো কাজ করতে দিলেই আমি সেটা ভুলে যাই
Next articleজাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here