নানা রকমের মানসিক রোগ, নানা রকমের ভুল ধারণা

0
39

হাসানুজ্জামান আল বান্নাহ
অ্যাসিস্টেন্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

সেদিন কথা হচ্ছিলো জনাব রায়হান সাহেবের সাথে। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক, বয়স আনুমানিক ৪৫ হবে। রায়হান সাহেব বলছিলেন, এইসব মানসিক রোগ আসলে সব বাহানা, পড়াশুনা ঠিকমতো করে না তাই পরীক্ষা আসলেই অজ্ঞান হওয়ার ভান করে যত্তসব আজগুবি বিষয়। এইসব শিক্ষার্থীকে আমার কাছে পাঠান, পিঠে দুই-চার ঘা পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে পরীক্ষাও দিতে পারবে।

এ ধরনের আরও বিভিন্ন ভুল ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে:

১. মানসিক অসুস্থতা আসলে বাস্তব না, আসলে এটা একটি ভুল ধারণা। মানসিক অসুস্থতা যেহেতু মনের বিষয় যা আসলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না তাই মানুষ এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
২. ছেলেদের কোনো মানসিক সমস্যা হয় না, এই ধারণাটি আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত এবং ঠিক এই ধরনের মানসিকতার কারণে পুরুষরা তাদের সমস্যাকে উপেক্ষা করতে গিয়ে বড় রকমের মানসিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে তাদের সমস্যার কথা কাউকে না বলতে পেরে সুইসাইডের পথ পর্যন্ত বেছে নেন।
৩. শিশুদের মানসিক রোগ হয় না। ছোটদের আবার কিসের মানসিক সমস্যা তাদের তো মনই নাই। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল, ছোটদেরও বিভিন্ন মানসিক সম্স্যা হয়, যেমন: অতি চঞ্চলতা, সেপারেশন অ্যাংজাইটি, অটিজম ইত্যাদি।
৪. মানসিক সমস্যা ভালো হয় না, বিষয়টি ঠিক নয়, বর্তমানে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা রয়েছে মানসিক সমস্যা নিরাময়ে (যেমন: ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য থেরাপী)।
৫. পাপের কারণে মানসিক রোগ হয়। অনেকেই এই ধারণা পোষণ করে থাকেন কিন্তু এটা আসলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে পাপের কারণেই রোগ হয়। মানসিক অসুবিধা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জেনেটিক বা বায়োলজিক্যাল কারণে হয়ে থাকতে পারে।
৬. মানসিক রোগীরা আগ্রাসী। মানসিক রোগীরা যে আগ্রাসী হয় তেমনটা আসলে সবসময় সঠিক নয়। এমন অনেক মানসিক রোগ আছে যেখানে একজন মানুষ আগ্রাসী আচরণ করেন না, যেমন: বিষন্নতা, শুচিবাই, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি।
৭. জ্বীনের আছরের কারণে মানসিক অসুবিধা হয়। এটিও একটি ভুল ধারণা। সবসময় জ্বীনের আছর করেছে তাই মানসিক রোগ হয়েছে এটা ভুল।
৮. মানসিক রোগীদের পাগল বলা হয়। মানসিক রোগী মানে পাগল এটিও ভুল ধারণা। পাগল বলতে সাধারণত মানুষ যেটি মনে করে যে তাদের সেন্সের ঠিক নেই বা বিচার—বিশ্লেষণ ক্ষমতা নেই। কিন্ত মানসিক সমস্যা বিষয়টি এত সহজ নয়। অনেকগুলো ধারাবাহিক ধাপ আছে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত গেলে এমনটা হয়।

আমরা বর্তমানে বাস করছি একুশ শতকের আধুনিক সমাজে। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় হলো এখন পর্যন্ত শারীরিক রোগ—বালাইগুলো যত সহজভাবে দেখি, মানসিক বিষয়গুলোকে সেভাবে মানতে চাই না এবং এই মানসিক রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ধারণা প্রচলিত আছে আমাদের বর্তমান সময়ের আধুনিক সমাজে এবং এই বিষয়টি এমনভাবে সমাজে কলঙ্কিত হয়ে আছে যে কেউ বুঝলেও অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে চায় না, আবার যার কারণে চিকিৎসা নিতেও অনীহা প্রকাশ করি।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লক্ষ মানুষ মারা যায় মানসিক সমস্যাজনিত কারণে। যা প্রতি বছর গড় মৃত্যুর ১৪.৩ শতাংশ এবং আরও জানা যায় যে, প্রতি ৪ জনে ১ জন মানুষ জীবনের কোনো একসময়ে মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ তো গেলো বিশ্ব পরিস্থিতি, আমার দেশের অবস্থাও খুব শোচনীয়। বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮—১৯ এর তথ্য অনুযায়ী ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুদের ১৪ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিষণ্ণতা রোগে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং উদ্বিগ্নতা রোগে ভুগছেন ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
সর্বোপরি মানুষের তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত এবং এখন এটি একটি সার্বজনীন মানবাধিকার।

 

 

Previous articleহিটস্ট্রোক প্রতিরোধে কী কী করণীয়, জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি
Next articleযেসব মানসিক রোগকে শারীরিক মনে হতে পারে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here