দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের মানসিক ও মানবিক বিপর্যয়

0
57

অফিসে যাওয়ার পথে প্রায়ই খেয়াল করি, কিছু লোক ঝটলা বেঁধে আছে। লাইনবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কারো জন্য। অবাক লাগে, এতোজন লোক কার জন্য করছে এই অপেক্ষা! কৌতুহলতা থেকেই একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কেন দাঁড়ান এখানে। জানতে পারলাম টিসিবির ন্যায্য দামে পণ্য কিনতেই এই লাইন।

বাংলাদেশে গত মাস দুয়েক ধরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। চাল-ডাল-ভোজ্যতেল-পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। এর মধ্যে গত সপ্তাহে বেড়েছে মসুর ডালের দাম। চলতি সপ্তাহেই আরেক দফা বেড়েছে সয়াবিনের দাম। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী এখন খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল এক লিটার ১৬৮টাকা।

সেই সঙ্গে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শীতের নতুন সবজিসহ প্রায় প্রতিটি শাকসবজির দামও বেশি।

খাদ্যপণ্যের এই দাম বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব পড়েছে – তা বোঝা যায় ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে ভিড় করা মানুষগুলোকে দেখে।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে এর প্রভাব সব শ্রেণীর লোকের ওপরই পড়ে, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি মূলত কম আয়ের লোকেদেরই বেশি ভোগায়। কিন্তু কেবল নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষজন নন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনও ভিড় করছে টিসিবি’র পণ্য কিনতে।

আর এই ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে। কারণ টিসিবি ট্রাকে করে সরকার ভর্তুকি দিয়ে বাজারের চেয়ে কম দামে পণ্য বেচে। ভর্তুকি দেয়া দামে চাল-ডাল-আটা-চিনি-তেল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন বহু মানুষ।

বৈশ্বিক এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশী অসহায় হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্তরা। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যের কষাঘাতে জর্জরিত এই মধ্যবিত্তের অবস্থা এতোটাই শোচনীয়। লোক-লজ্জা, সামাজিক মর্যাদার ভয়ে নিজেদের আড়াল করতে চাইলেও দ্রব্যমূল্যের দূরাবস্থা টেনে বের করে এনেছে তাদের।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে আসা তথ্যমতে, করোনার এ সময়ে আয় কমেছে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মজীবীর। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন দেশের চাকরি, ব্যবসাসহ নানা পেশায় জীবিকানির্বাহ করা মধ্যবিত্তরা। এই শ্রেণির অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন, আবার কারো বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্য কাজের উত্সগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সংসার চালানোর নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। কারো সংসারের খরচ কমাতে কমাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে কিন্তু বলতে পারছেন না। রাজধানীসহ সারা দেশের মধ্যবিত্তের চেহারায় এখন বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট।

দেশে সব কিছুতেই মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। দেশের রাজনীতি, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যবিত্তদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, দেশে তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে মধ্যবিত্তের মাসিক আয় ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। যে কোনোভাবে আয় করে যারা এ ধরনের একটি সামাজিক মর্যাদা তৈরি করেছেন, তারাই মধ্যবিত্ত।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয় তবে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এ হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ৩ কোটি ৭ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসাবটি একটু বেশি। যাদের প্রতিদিন আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার, তারা মধ্যবিত্ত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে চার ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসাবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা, সে-ই মধ্যবিত্ত। এটি বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসেবে সেই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮০ লাখ।

সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ। আয় কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের। ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ৩ শতাংশের চাকরি থাকলেও বেতন পান না। এদের বড় অংশই মধ্যবিত্ত।

উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। করোনার কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরেও ধস নেমেছে। এতে বেড়েছে দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা।

সম্প্রতি ‘প্রিভিলেন্স অব এনজাইটি এন্ড ডিপ্রেশন ইন সাউথ এশিয়া ডিউরিং কোভিড-১৯; এ সিষ্টেমেটিক রিভিউ এন্ড মেটা-এনালাইসিস’ এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ এক তথ্য। যেখানে দেখানো হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথমে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন- ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশী। তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। করোনার কারণে মানুষের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। সঙ্গত কারণে দুশ্চিন্তা, হতাশা, অনিদ্রা, মাদকাসক্তি বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক বৈরীতার কারণে মানসিক সংকট ও সৃষ্টি হয়েছে’।

করোনায় নিম্ন আয়ের লোকজন সরকার ও বিত্তবানদের কাছ থেকে নানা সাহায্য-সহায়তা পেলেও মধ্যবিত্তরা সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় কারো কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতে পারেনি। তাদের সহায়তা দিতেও সরকার কিংবা বিত্তবানরা কেউ এগিয়ে আসেননি। এর মধ্যে বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের একটি বড় অংশ টিউশনি করে, নিজের লেখাপড়া নিজেই চালাতেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সে সুযোগও প্রায় বন্ধ। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। যেন, মধ্যবিত্ত এক অভিশাপের নাম।

লিখেছেন- শরীফুল সাগর

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

 

Previous articleআমার মনে হতে থাকে, আমি মারা যাব
Next articleসার্ক সাইকিয়াট্রিস্ট ফেডারেশন – অধ্যাপক ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here