দোষারোপ নয়, সন্দেহ তবে কি?

যৌন আচরণে বংশগতির প্রভাব অনেক

ইদা‌নিং রাগ একদমই কন্ট্রোল হচ্ছে না। বাচ্চার গায়ে যখন তখন হাত উঠে যাচ্ছে। আসলে বাচ্চারও কোন দোষ নেই। আমার হাতের কাছে মারার মত ও‌কেই পাওয়া যায়। ঘরে আছে শ্বাশু‌ড়ি তাকে তো আর কিছু বলা যায় না। সংসার চলেই তার হুকুমে। স্বামী বিদেশে থাকেন।

বললাম-রাগ করে আর কিছু করেন?

হ্যাঁ ক‌রি। মোবাইল ভেঙে ফে‌লি। এই নিয়ে তিনটা সেট ভে‌ঙে‌ছি।

বুঝলাম বার বার রে‌গে যাওয়ার পিছ‌নে মোবাই‌লেরও সম্পর্ক আ‌ছে। জান‌তে চাইলাম সেট কখন কিভা‌বে ভে‌ঙে ফে‌লেন। উত্ত‌রে পা‌শে বসা মে‌য়ে‌টি‌কে দে‌খি‌য়ে বললো ওর বাবার সা‌থে রাগ ক‌রে।

একটু থে‌মে আবার যোগ কর‌লো ইদা‌নিং ওর বাবা‌কে আ‌মি একদমই সহ্য কর‌তে পার‌ছি না। স্যার আপ‌নি ঔষধ দিন। রাগ কমা‌নোর ঔষধ। আমার সংসারটা বাঁচুক। মে‌য়েটাও আমা‌কে ভয় পে‌তে শুরু ক‌রে‌ছে। এক‌দিন আ‌মি ওর গলা চে‌পে ধ‌রে‌ছিলাম। সে‌দিন কেউ বাধা না দি‌লে আমি হয়ত ও‌কে মে‌রেই ফেলতাম।

ভদ্রম‌হিলা কি ভয়াবহ রা‌গের সমস্যায় ভুগ‌ছেন সেটা তার কথায় বোঝা গে‌লো। আ‌রো বোঝা গে‌লো তার রা‌গের সা‌থে ক‌য়েক‌টি বিষয় জ‌ড়ি‌য়ে আ‌ছে মোবাইল ফোন, মে‌য়ে এবং তার স্বামী।

দুবছর আ‌গেও সব‌কিছু ঠিকঠাক চল‌ছি‌লো। মেয়েকে নি‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লো সরকারি স্কু‌লে ভর্তি করা‌তে। স্কু‌লের কা‌ছেই এক‌টি স্টেশনারী দোকান থেকে ফরম ফিলাপ ক‌রে জমা দি‌য়ে‌ছি‌লেন অনলাই‌নে। যে ক‌ম্পিউটার অপা‌রেটর তার কাজ ক‌রে দি‌য়ে‌ছিল সে জানা‌লো রে‌জি‌স্ট্রেশ‌নে ভুল হয়ে‌ছে আ‌রেক‌টি নাম্বার দি‌য়ে রে‌জি‌স্ট্রেশন কর‌তে হ‌বে।

ভদ্রম‌হিলার কা‌ছে আর কোন সিম ছি‌লো না। প‌রে ঐ ক‌ম্পিউটার অপারেটর তার নি‌জের সিম দি‌য়ে রে‌জি‌স্ট্রেশন ক‌রে দেয়। পরবর্তী‌তে ভর্তির খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ঐ অপা‌রেট‌রের নাম্বার‌টি তা‌কে নি‌য়ে আস‌তে হয়। মা‌ঝে মা‌ঝে ফোন ক‌রে ভর্তির রেজাল্ট জান‌তে চাই‌তেন। এক‌দিন অপা‌রেটর তা‌কে প্রে‌মের প্রস্তাব দেয়। তি‌নি বিবা‌হিত, স্বামী-সন্তান আ‌ছে বল‌লে অপা‌রেটর তা‌কে স্বামী কে মে‌রে ফে‌লে তার কা‌ছে চলে আস‌তে ব‌লে।

ভদ্রম‌হিলা যখন রা‌জি হন না তখন ঐ অপা‌রেটর তা তার স্বামীর প‌রিবার‌কে জা‌নি‌য়ে দেয়। এরপর থে‌কেই শুরু যন্ত্রণা। তার স্বামী এবং স্বামীর পরিবার তা‌কে স‌ন্দেহ কর‌তে শুরু ক‌রে যা তি‌নি নি‌তে পা‌রেন না।

মেজাজ খারাপ হ‌য়ে যায়। কখ‌নো মোবাইল সেট আছাড় মেরে ভে‌ঙে ফে‌লেন, মে‌য়ে‌কে মা‌রেন, রাগ ক‌রে কল কে‌টে দেন। ও‌দি‌কে স্বামী প্রবাসে ব‌সে আ‌রো অ‌স্থির হ‌য়ে প‌ড়েন। ফোন ক‌রেই কিভা‌বে তি‌নি দুশ্চিন্তায় কষ্ট পা‌চ্ছেন, নাওয়া খাওয়া ঘুম কিভা‌বে নষ্ট হ‌চ্ছে ‌সেসব বলতে থা‌কেন, স্ত্রী‌কে বোঝা‌তে থা‌কেন।

ভদ্রম‌হিলা ভিত‌রে আহত হ‌তে থা‌কেন তা‌কে না বোঝার জন্য, আহত হতে থা‌কেন অপবাদ দেওয়ার জন্য, আহত হ‌তে থা‌কেন তা‌কে খারাপ মে‌য়ে ভাবার জন্য। কিন্তু স্বামীর প‌ক্ষে দূ‌রে ব‌সে তা বোঝা সম্ভব হয় না। স্ত্রী‌কে হারা‌নোর ভ‌য়ে তি‌নি আ‌রো ব্যকুল হ‌য়ে বোঝা‌তে থা‌কেন।

অবস্থা এখন এমন হ‌য়ে‌ছে ‌স্বামীর ফোন আর ধর‌তে ইচ্ছা ক‌রে না। এক তরফা ভা‌বে বু‌ঝে যাওয়া আর সহ্য হয় না। কথা চলাকা‌লিন ফোন রে‌খে দেন, মে‌য়ে‌কে মা‌রেন কখ‌নো বা নি‌জে‌কেও। কোন ফল হয় না।

ভদ্রম‌হিলার এমন আচরণে স্বামী পক্ষ যা বোঝার বু‌ঝে নেয়। তারা ধ‌রে নেয় তাদের বৌ এর সংসা‌রে আর মন নেই। মন চ‌লে গে‌ছে অন্যখা‌নে।

বিষণ্ণতা, সমা‌জে হেয় হওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বে‌ড়েই যা‌চ্ছে। ঘুম নেই, ম‌নে শা‌ন্তি নেই, সারাক্ষণ উ‌দ্বিন্নতা, খিট‌খি‌টে মেজাজ। দু‌শ্চিন্তা আর বিষণ্ণতার ঔষ‌ধে হয়ত ভদ্রম‌হিলার কষ্ট কিছুটা প্রশ‌মিত হ‌বে। ‌কিন্ত প্রবাসের মানুষ‌টি‌কে দু‌শ্চিন্তা মুক্ত না কর‌তে পার‌লে সমস্যাটার স্থায়ী সমাধান হ‌বে না।

রাগ নিয়ন্ত্রণ কি কোন কা‌জে আস‌বে? না তাও না। ধরুন আপ‌নি ভা‌তের হা‌ড়ি‌তে পা‌নি দি‌য়ে ব‌সি‌য়ে দি‌লেন চুলার উপর। আগুনের তা‌পে পা‌নি ফুট‌তে শুরু করে‌ছে। আগুনের আঁচ না ক‌মি‌য়ে আপ‌নি য‌দি ভা‌বেন পানি ফোটা বন্ধ কর‌বেন তাহ‌লে এ অবস্থায় রাগ নিয়ন্ত্রণ তেমনই হ‌বে।

দুজ‌নের ভেত‌রে যা চল‌ছে তা বন্ধ কর‌তে না পার‌লে কোন কিছুই কোন কা‌জে আস‌বে না। দুজ‌নের ভেত‌রে কি চল‌ছে আসুন তা আবার একটু ভে‌বে দে‌খি-

দূর প্রবা‌সে ব‌সে ভদ্র‌লোক জান‌তে পার‌লেন তার স্ত্রী কোন এক কম্পিউটার অপা‌রেট‌রের সা‌থে কথা ব‌লে‌ছেন। যি‌নি তা‌কে হত্যা ক‌রে তার স্ত্রী‌কে পে‌তে ইচ্ছুক।

ভদ্রম‌হিলা এ রকম কিছুই ক‌রেন নি। ক‌ম্পিউটার অপা‌রেটর নি‌জে থেকেই প্র‌পোজ ক‌রে‌ছেন। নি‌জে থে‌কেই এ ধর‌নের প‌রিকল্পনা করেছেন।

ভদ্র‌লোক এতটাই প্র‌তি‌ক্রিয়াশীল হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছেন যে তার প্রাত্য‌হিক কাজকর্ম কর‌তে পার‌ছেন না। স্ত্রী‌কে বার বার তার প্র‌তি‌ক্রিয়ার কথা বলছেন। ভদ্রম‌হিলাও এতে প্র‌তি‌ক্রিয়াশীল হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছেন। তি‌নিও আর স্বভা‌বিক থাক‌তে পার‌ছেন না। দুজ‌নেরই মান‌সিক স্বাস্থ্যের য‌থেষ্ঠ অবনতি হ‌য়ে‌ছে।

প্রাথ‌মিকভা‌বে বা অ‌তি সত্বর আমরা যা পা‌রি তা হ‌চ্ছে ঔষ‌ধের মাধ্য‌মে তা‌দের মান‌সিক স্বা‌স্থ্যের অবন‌তি রোধ করা এবং ভারসাম্য ফি‌রি‌য়ে আনা। কাউ‌ন্সি‌লিং‌য়ের মাধ্য‌মে পু‌রো প‌রি‌স্থি‌তি সম্প‌র্কে অবগত করা এবং স‌চেতন ক‌রে তোলা।

এরপর যে কাজ‌টি করা দরকার সে‌টি হ‌লো তা‌দের ম‌ধ্যে এক‌টি স্বাস্থ্যকর সং‌যোগ স্থাপন ক‌রে দেওয়া। যেন একজন আ‌রেকজ‌নের কথায় অপমানিত না হন, আহত না হন। ম‌নে রাখ‌বেন দাম্পত্য সম্প‌র্কে কাউকে স‌ন্দেহ করা ছোট খাট বিষয় নয়। কাউ‌কে স‌ন্দেহ কর‌লে অসত্যার দোষ তার উপর চে‌পে ব‌সে।

স‌ন্দেহ আস‌তেই পা‌রে, ত‌বে প্রকাশ ক‌রে ফেল‌লে অ‌নেকটা দোষী সাব্যস্ত করা হ‌য়ে যায়। নি‌জে‌কে নি‌র্দোষ প্রমান করার দা‌য়িত্ব অ‌ভিযুক্ত ব্য‌ক্তির উপর বর্তায়। সেখান থে‌কে সম্প‌র্কে ফাটল ধর‌তে শুরু ক‌রে।

যা করা যেতে পারে

ম‌নে স‌ন্দেহ এলে কথা বলুন, এমন ভা‌বে কথা বলুন যেন অ‌ভি‌যোগ হ‌য়ে না যায়, দোষা‌রোপ এ‌ড়ি‌য়ে চলুন, স‌ন্দেহ নিরস‌নে সঙ্গীর কথা মূল্যায়ন করুন। পর্য‌বেক্ষন করুন নি‌জে‌দের মধ্যকার ঘ‌নিষ্ঠতা, বিশ্বাস রাখুন নিজের ওপর ও সঙ্গীর ওপর।

Previous articleকরোনায় কর্মক্ষেত্রে তরুণ সমাজের হতাশা ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি
Next articleকিভাবে বুঝবেন অটিজম নাকি বিকাশজনিত অন্য কোনো সমস্যা
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here