দুর্যোগ কিংবা জরুরি অবস্থায়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন সহজে পাওয়া যায় – এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BMU) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের আয়োজনে পালিত হলো বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫। এ উপলক্ষে শনিবার সকালে ক্যাম্পাসে এক বর্ণাঢ্য র্যালি ও বৈজ্ঞানিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণে এক বর্নাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সেমিনারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয় । পরবর্তীতে দূর্যোগ ও দূর্যোগ পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যর উপরে এক বিশেষ মঞ্চ নাটক উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডা. সাইদুল ইসলাম সাইদ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
সেমিনারে মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত প্রেজেন্টেশন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. আরিফুজ্জামান। তিনি জানান, ২৫৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, ৭১ শতাংশ ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ ২৯ শতাংশের, ফ্লাশব্যাক ২৬ শতাংশ, ক্ষুধামান্দ্য ২৬ শতাংশ, মনোযোগের ঘাটতি ২০ শতাংশের, কাজের অনাগ্রহ ২০ শতাংশের।
কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অধিকাংশ মানুষই মানসিক চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না উল্লেখ করে। এই প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেন্টাল হেলথ সার্ভিস চালু করার চেষ্টা করবে মন্ত্রণালয়। এমনটা জানিয়েছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তিনি আরও বলেন, অনেক কাজের উদ্যোগ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। তবে এবার মেন্টাল হেলথ সার্ভিস চালুর চেষ্টা করা হবে। কোনো দুর্ঘটনার পর মানসিক চিকিৎসার জন্য সরকার থেকে ফান্ড না দেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, বিমান বিধস্তের ঘটনায় আমরা তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির ২৮ শিশুকে হারিয়েছি। তিন শিক্ষিকা, তিন অভিভাবক, এক আয়া ছাড়াও পথচারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে ঘুমাতে পারে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা এমন শিক্ষার্থী পেয়েছি, যারা ঘটনার দিন স্কুলে ছিল না। তারপরও মানসিক সমস্যায় ভুগছে। চোখ বন্ধ করলে নিজের ওপর বিমান পড়ছে দেখতে পায় বলে তারা ঘুমাতে পারছে না জানিয়েছে। খেতে পারছে না। এমন এক শিক্ষার্থীকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে কিছুটা সুস্থ করতে পেরেছি।
মানসিক স্বাস্থ্যকে এসেন্সিয়াল হেলথ সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটো বলেন, সব ধরনের একাডেমিক সিলেবাসে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এরই সাথে মানসিক স্বাস্থ সেবায় সকল কার্যক্রমের জন্য মিনিস্ট্রিকে এগিয়ে আসতে হবে এরই সাথে দক্ষ জনবল নিয়োগও প্রয়োজন। সবাইকেই রাষ্ট্র নিয়ে ভাবার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কেউ কখনও কোনো দুর্যোগের সময় কথা বলেনা উল্লেখ করে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের এখন দরকার মানুষের দাঁড়গোরায় পৌঁছানো। আমাদের নীতিনির্ধারকদের থেকে সহযোগিতা ও বাজেট প্রয়োজন যেকোনও ধরনের দুর্যোগে মোকাবেলায় মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়ার জন্য ।
ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস – এর সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রতি সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। সবাইকে বুঝতে হবে কার কখন মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নেয়া দরকার।
অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত ও আয়োজনে সহায়তাকারী সকলের নিকট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব।
বক্তারা দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ আয়োজন সকলের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়কে কেন্দ্র করে গবেষণা, আলোচনা ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে থাকবে। আশা করা যায়, এ ধরনের উদ্যোগ দেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অগ্রগতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যতে দুর্যোগকালীন মুহূর্তে মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করবে।
আরও পড়ুন-