তিনজন টোকাই বই পড়ছে থেকেই তেজস হালদার জসের যাত্রা শুরু

তেজস হালদার জস

প্রতিভাবান তরুণ ভাস্কর শিল্পীদের মধ্যে তেজস হালদার জস অন্যতম এক নাম। যিনি জীবনের শুরু থেকেই স্বপ্ন বুণে ছিলেন একজন ভাস্কর শিল্পী হওয়ার। আজ তিনি সফল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকেই তিনি অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার জয়নুল অ্যাওয়ার্ডের গোল্ড মেডেল ও এশিয়ান অ্যাওয়ার্ড। মনের খবর পাঠকদের জন্য তাকে নিয়েই আজকের তারকার মন। তার মনের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন হাসনাত নাঈম।

মনের খবর: কেমন আছেন?

তেজস হালদার জস: জ্বি, ভালো আছি।

মনের খবর: ভাস্কর শিল্পে আগ্রহটা কিভাবে আসলো?

তেজস হালদার জস: আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি, তখন আমাকে স্কুল থেকে বলা হয়েছিলো মাটি দিয়ে কিছু একটা করে নিয়ে আসার। তখন বাড়ী ফিরে এটেল মাটি সংগ্রহ করে একটি গরু বানিয়ে ছিলাম। গরু দেখে বাবা আমায় বলেছিলেন, ভারী সুন্দর হয়েছে। এটাই আমার অনুপ্রেরণা।

সেন্ট পলস স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমি আবার একটা নতুন পরিবেশ পাই। যেখানে ছবি আঁকা, নাচ, গান সবই হয় পড়ালেখার পাশাপাশি। হোস্টেলে থাকাকালীন সময়ে আমি একটা চার্চের লাইন ড্রয়িং স্ক্রাচ করি। চার-পাঁচ দিন সময় নিয়ে এই ফুলের স্ক্রাচটি করেছি। তখন আমার হেডমাস্টার বলেছিলেন, এর থেকে ভালো স্ক্রাচ আমি দেখি নাই। এটা হচ্ছে আরো একটি অনুপ্রেরণা।

এরপর এসএসসি শেষ পর্যন্ত আমি থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিটি প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। উচ্চ মাধ্যমিকের সময়ে এই বিষয়টা থেমে থাকলেও পাশ করার পরপরই এটি আবার আমার মাথা আসে। এরপরই চারুকলায় ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মনের খবর: ভাস্কর শিল্পে প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

তেজস হালদার জস: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আবার কাজ শুরু করলাম। শিক্ষকরা তখন বিভিন্ন কথা বলে, তাদের কথা মাঝে মাঝে বুঝতাম না। আমি নিজের মতো করেই কাজ করে যেতাম। ২০০৩ আমার জীবনে প্রথম একটি বড় ভাস্কর্য তৈরি করি। কিন্তু ম্যাটারিয়ালগত অভিজ্ঞতা না থাকায় সেটি দ্রতই ভেঙ্গে যায়।

এরপর তিনজন টোকাই বই পড়ছে, এমন একটা ভাস্কর্য তৈরি করি। যেটির নাম ছিলো সিংক। এটির মাধ্যমে চারুকলাতে জয়নুল অ্যাওয়ার্ড গোল্ড মেডেল পাই এবং এরপর পাই এশিয়ান অ্যাওয়ার্ড। মূলত এখান থেকেই আমার ভাস্কর শিল্পে যাত্রা শুরু হয়।

মনের খবর: ছোটবেলায় কি হওয়ার ইচ্ছে ছিল?

তেজস হালদার জস: বাবার অনুপ্রেরণার পর থেকেই শিল্পী হওয়ার ছিলো। পরে আস্তে আস্তে দেখলাম ভাস্কর শিল্পী হয়ে গেছি।

মনের খবর: প্রতিটি মানুষ স্বপ্ন দেখে, তেমন আপনিও দেখেন। আপনার স্বপ্ন গুলো কেমন?

তেজস হালদার জস: ভাস্কর্য তৈরির জন্য বড় খোলা জায়গার প্রয়োজন হয়। এটা বাসার ভেতরে করা সম্ভব না। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে যেসব শিক্ষার্থী বের হয়ে কাজ করতে চায়, কিন্তু জায়গার অভাবে পারে না। তাদের জন্য একটা বড় কমন স্টুডিও তৈরির স্বপ্ন আছে এবং কাজ করে যাচ্ছি।

মনের খবর: একটি ভাস্কর তৈরিতে কেমন সময় লাগে?

তেজস হালদার জস: ভাস্কর্য একটি আলাদা মিডিয়া। একটি ছোট আকারের ভাস্কর্য তৈরিতেও ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। আর বড় ভাস্কর তৈরিতে ৬ মাস থেকে এক বছরও সময় লাগে।

মনের খবরআমাদের দেশের ভাস্কর শিল্পের বর্তমান অবস্থা কেমন?

তেজস হালদার জস: বাংলাদেশের ভাস্কর শিল্পের অবস্থা ভালো এবং দেশে প্রচুর ট্যালেন্ট ভাস্কর আছে। কিন্তু জায়গা আর অনুশীলনের অভাবে তারা সামনে আসতে পারছে না

মনের খবর: সব মানুষেরই তো রাগ হয়, আপনার রাগ কেমন?

তেজস হালদার জস: আমার রাগটা একটু বেশি। আমি রাগলে মানুষের সঙ্গে খুবই রিএক্ট করি। মনে হয়, এখনি সব ভেঙ্গে চূড়ে ফেলবো।

মনের খবররাগ দমন করেন কিভাবে?

তেজস হালদার জস: আমার রাগ দমন করতে সময় লাগে। রিএক্টের পর শান্ত থাকার চেষ্টা করি। এবং বুঝতে পারি, কাজটি করা ঠিক হয়নি।

মনের খবরকষ্ট পেলে কি করেন?

তেজস হালদার জস: কষ্ট পেলে আমি নিজের মতই থাকি। শেয়ারিংটা খুব একটা করা হয় না। আর ঐ সময় স্টুডিওতে থাকলে বিষয়টা খুব একটা গায়ে লাগে না।

মনের খবর: হতাশায় ভোগেন কিনা?

তেজস হালদার জস: আমার কাজের পরিচিতি পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষ থেকেই। কিন্তু আমি যখন ভারত থেকে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরি তখন আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, সে সময় আমার কাজ করার জায়গা, অর্থ, কমিশন ও শো কিছুই করতে পারছিলাম না। নানা মানুষে আমাকে বলছে, তুমি অন্য কিছু করো। আমি সেই সময়টায় বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।

মনের খবরআপনি ঘুমান কতক্ষণ?

তেজস হালদার জস: আমি রাত ১২ টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এই ৮ ঘন্টা ঘুমাই। বাকি সময়টা কাজ আর পরিবারের সঙ্গে কাটে।

মনের খবরস্মৃতি মানুষের জীবনের একটি অংশ। নিশ্চয় আপনারও স্মৃতি আছে। আপনার সেই স্মৃতিগুলো কেমন?

তেজস হালদার জস: আমার স্মৃতিতে দুইটি বিষয়ই ভাসে। একটা হচ্ছে বাবা বলেছিলেন, ‘ভারী সুন্দর হয়েছে’ এবং অন্যটি হচ্ছে আমার শিক্ষক বলেছিলেন, ‘এর থেকে ভালো স্ক্রাচ আমি দেখি নাই’।

মনের খবর: মনের যতœ নেন কিভাবে?

তেজস হালদার জস: আমি প্রচুর মিউজিক শুনি। কাজের সময় বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক শুনি।

মনের খবর: পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে কেমন লাগে? আপনার কাজকে পরিবার কিভাবে দেখে?

তেজস হালদার জস: পরিবারকে তো সময় দিতেই হয়। অনেক সময় কাজ বাদ দিয়েও সময় দিতে হয়। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো আনন্দের ব্যাপার, অবশ্যই ভালো লাগে। পরিবারকে বাদ রেখে তো কিছু করা সম্ভব না। আমি যে কাজটি করি সেটি পরিবারের জন্যই। আর পরিবারও আমার কাজকে সাপোর্ট করে।

মনের খবর: জীবন নিয়ে ভাবনা কি আপনার?

তেজস হালদার জস: আসলে জীবন নিয়ে ভাবনাটা কাজের সঙ্গেই জড়িত। কাজটা মনোযোগ দিয়ে করতে চাই।

মনের খবর: ভাস্কর শিল্পে নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

তেজস হালদার জস: আমি নতুনদের একটা কথাই বলতে চাই, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষ খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে তার ভালো হয় বা খারাপ হওয়ার সুযোগ থাকে। ভাস্কর শিল্পে যদি কেউ সফল হতে চায় তবে তাকে বলবো, ভাস্কর্য হচ্ছে একটি গবেষণা, সাধনা।

একজন ভাস্কর নিজের মতো করে সবসময় কাজ করে যাবে, এটাই নিয়ম। পাশ করে বের হওয়ার পর ৪/৫ বছর নূন্যতম ধৈর্য ধরে এই কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ, এই সময়টাই কাজে পরিচিতি পাওয়ার সময়। মানুষকে তার কাজ সম্পর্কে জানাতে হবে। তবেই সে সামনে এগিয়ে আসতে পারবে।

মনের খবর: মনের খবরকে সময় দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ।

তেজস হালদার জস: মনের খবরের জন্য শুভকামনা।

Previous articleরোগের নামেই ভয়
Next articleকরোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here