ড্রাইভারের অশান্ত মন দুর্ঘটনার বড় কারণ!

সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালক হাবিবুর রহমান। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিশ্বস্ততার সাথে চাকরি করছেন তিনি। গাড়ি চালনায় হাতেখড়ি তারও প্রায় বছর সাতেক আগে। প্রতিষ্ঠানের বড়ো কর্তাদের দূরের যাত্রায় গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তিনি-ই প্রথম পছন্দ। কিন্তু বিগত ছয় মাস ধরে গাড়ি চালানোই যত দূর সম্ভব এড়িয়ে চলছেন হাবিবুর রহমান। অসুস্থতা বা অন্য কোনো ছুতোয় ছুটি নিচ্ছেন, দূরের যাত্রায় তো নয়-ই, রুটিন ডিউটি পালনেও তার তীব্র অনীহা। সহকর্মী, ঊর্দ্ধতন কর্তা ব্যক্তিদের উপর্যুপরি প্রশ্নের মুখে অবশেষে তিনি জানান, আজকাল গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিলেই তার বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। এই বুঝি কোনো গাড়ি তাকে ঠুকে দিল বা তিনি-ই গাড়ি চড়িয়ে দিলেন কোনো পথচারীর গায়ের ওপর। অথবা পাশের ফুটপাতে আছড়ে পড়ল গাড়ি, বৈদ্যুতিক পিলার বা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে গেল।

এ সমস্যা শুরুর কারণটাও জানা গেল। মাস ছয়েক আগে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গাড়ি চালানোর সময় তার চোখের সামনেই ঘটে ট্রাক-বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। তীব্র আতঙ্ক হলেও সময়মতো ব্রেক কষায় দুর্ঘটনাস্থলের কয়েক গজ আগেই থেমে যায় তার গাড়ি, উল্টে যাওয়া ট্রাক তার গাড়িকে আঘাত করতে পারেনি। সেদিন রাতে টিভিতে দেখেন সেই দুর্ঘটনায় মৃত মানুুষের ছবি আর পরের দিন খবরের কাগজে পড়েন ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন। একই দিনে পত্রিকার পাতায় ছিল আরো কয়েকটি বড়ো দুর্ঘটনার সচিত্র বিবরণ। এরপর থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিলেই হাত কাঁপতে থাকে তার।

এ সমস্যার কথা জানাজানি হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন জানান হাবিব। কিন্তু বড়ো কর্তারা ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তার আবেদন গ্রহণ না করে তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান। কয়েক মাসের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে আবার গাড়ি নিয়ে পথে নামেন হাবিব।

চালক ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী বা পথচারীরাও ভুগতে পারেন এমন নানা মানসিক সমস্যায়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনোভাবেই এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই না কেন, এ ধরনের ঘটনা আমাদের মনে চাপ ও কষ্টের সৃষ্টি করে। এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া কিছুটা তীব্র হয়। আবার, সময়ের সাথে সাথে আমরা এর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও আসি। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই তীব্র মানসিক চাপজনিত সমস্যা (অ্যাকিউট স্ট্রেস রি-অ্যাকশন) কমে আসে। তবে, সবাই অতটা সৌভাগ্যবান নন। কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। যোগ হয় নতুন নতুন উপসর্গ। অথবা প্রাথমিকভাবে কোনো সমস্যা না হলেও পরবর্তীতে এমনকি বছর কয়েক পরেও এই দুর্ঘটনার সূত্র ধরেই মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে পারেন অনেকে।

দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়পরবর্তী মানসিক চাপের উপসর্গগুলো ব্যক্তির জন্য প্রবল যন্ত্রণাদায়ক। এই সব উপসর্গ ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ভয়ংকর ঐ দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বারে বারে ফিরে আসে। ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো শব্দ, দৃশ্য বা আলোচনা ব্যক্তির মনে সে স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। চলমান ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই স্মৃতি। মনে হয় যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে জীবনে। ব্যক্তি একইরকম ভয়, আতঙ্ক, বেদনা অনুভব করেন, যেমন অনুভূতি হয়েছিল প্রকৃত ঘটনাটির সময়। রাতে ঘুমুতে গেলেও দুঃস্বপ্নে হানা দেয় সেই স্মৃতি।

কেউ কেউ আবার হয়ে পড়েন অস্থিরচিত্ত। তারা উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত আচরণ করেন, সবসময় যেন কোনো বিপদাশঙ্কায় মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকেন। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, ঘুম কমে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে শারীরিক নানা সমস্যা যেমন-মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা বা ম্যাজ ম্যাজ করা, বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা কাঁপা, খাওয়ায় অরুচি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন, প্রত্যক্ষদর্শীরা দুর্যোগ থেকে অন্যদের বাঁচাতে না পারার জন্য অপরাধবোধে ভোগেন।

অনেকের আবার এরকম কোনো দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা ছাড়াও গাড়ি চড়ায় অহেতুক এক ধরনের ভীতি বা ফোবিয়া থাকতে পারে। বাস-ট্রেনে চড়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের ভীতি বেশি দেখা গেলেও ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাসে চড়তেও কেউ কেউ ভীত থাকেন। গাড়িতে চড়লেই তাদের ভেতর অস্থিরতাসহ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা যায়। গাড়ির মালিক হয়েও ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় পথ চলতেও দেখা যেতে পারে।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ চালকের গাড়ি চালনায় হঠাৎ ভীতি যেমন মানসিক কোনো সমস্যার কারণে হতে পারে, তেমনি অভিজ্ঞ বা অনভিজ্ঞ চালকের হঠাৎ বেপরোয়া চালনাও কিছু ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা নির্দেশক। বিশেষত বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা ম্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেপরোয়াভাব পরিলক্ষিত হয়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি গাড়ির মালিক হলে অস্বাভাবিকভাবে ঘন ঘন গাড়ির মডেল পাল্টাতে বা নতুন গাড়ি কিনতে দেখা যেতে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তীব্র আসক্তির পর্যায়ে বা উইথড্রল পর্যায়ে দিগ্বিদিকশূন্য গাড়ি চালাতে পারেন। আবার তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত বা আত্মহত্যা-প্রবণ ব্যক্তির হাতেও গাড়ির ভার ছেড়ে দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

আমাদের দেশে বিরল হলেও উন্নত দেশগুলোতে গাড়ির সাহায্যে আত্মহত্যা হরহামেশাই ঘটে থাকে। আরো কিছু মানসিক রোগ রয়েছে যার উপসর্গ প্রকাশিত হতে পারে গাড়ির মাধ্যমে। যেমন, অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বা শুচিবায়ু ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গাড়ির ব্যাপারেও খুঁতখুঁতে হতে দেখা যেতে পারে। গাড়ি কেনা, পরিষ্কার রাখা বা চালনা-যেকোনো ক্ষেত্রেই এই খুঁতখুঁতে ভাব স্বাভাবিকতার সীমা ছাড়িয়ে জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।

বিশেষ কিছু ব্যক্তিত্ব-বৈকল্য বা পার্সোনিলিটি ডিজঅর্ডার, ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার প্রভৃতিতে আক্রান্ত কোনো কোনো ব্যক্তির গাড়ি ভাঙচুরের ঝোঁক দেখা দিতে পারে। গাড়ি চালকদের শারীরিক সক্ষমতার সাথে সাথে মানসিক সক্ষমতার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হয়। মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের গাড়ি চালনায় কিছু ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ রয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের সময় ও নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনকালীন সময়ে গাড়ি চালাতে নিষেধ করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটি মেনে চলা উচিত।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleপ্যারিডোলিয়া: বিভিন্ন কাজে মানুষের মুখের অবয়ব দেখতে পাওয়ার সমস্যা!
Next articleবাংলাদেশে করোনার নতুন ৩৪ ধরনের মিউটেশন পেয়েছেন গবেষকরা
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here