গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে যা করবেন

ভ্রুণ অবস্থা থেকেই মানব শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়।
তার বুদ্ধি, বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যক্তিত্বের ভিত্তি নির্মিত হয় সেখানেই। ঠিক এ  কারণেই আপনার শিশুর জীবনের এই পর্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিটি ভ্রূণই খুব সংবেদনশীল। ভ্রুণাবস্থায় মস্তিষ্কের বিকাশ দীর্ঘ হলে তা একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থা থেকে শিশুর জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়।

Pregnancy baby right brain development

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভ্রুণের বিভিন্ন বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উৎস এবং খাদ্য উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ কারণে যে খাদ্য উপাদানগুলো ক্ষতিকর তা সচেতনার সঙ্গে এড়িয়ে চলতে হবে। সে সঙ্গে পুষ্টিকর ও উপকারী খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমেই শিশুর ভবিষ্যৎ অস্বাভাবিকতার ঝুঁকি বহুলাংশে এড়ানো সম্ভব।

এছাড়া শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য যে বিষয় বা উৎসগুলো ঝুঁকিপূর্ণ তা এড়িয়ে চলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ উৎসগুলো হলো-

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ বা স্ট্রেস শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। ঝুঁকি বাড়তে পারে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার। গর্ভাবস্থার প্রথম মাস থেকেই যে মা গুরুতর মানসিক চাপে ভুগে থাকেন তার শরীরে এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয় যা ভ্রূণের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ অজাত শিশুর (unborn child) ঝুঁকি বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে শিশুর বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

মায়ের মানসিক অবস্থা: ভ্রূণ যেহেতু সংবেদনশীল তাই মায়ের মানসিক অবস্থা দিয়ে তা খুব সহজেই প্রভাবিত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক চাপ শিশুর জন্মগত মস্তিষ্ক ঠিকঠাক ভাবে গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। মায়ের মানসিক অবস্থা ভালো না থাকলে অজাত শিশুর মস্তিষ্ক ঠিকভাবে গঠিত হতে পারে না এবং ঝুঁকি বাড়াতে পারে শিশুর পরবর্তী জীবনে বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়াসহ বিভিন্ন মানসিক রোগের।

রোদের অভাব: সূর্যালোকে থাকা ভিটামিন ডি ভ্রুণের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে মায়েরা গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস সূর্য আলোতে কম যান তাদের সন্তানদের পরবর্তী জীবনে একাধিকবার স্ক্লোরোসিস (টিস্যু সংক্রান্ত রোগ) হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

ধূমপান: তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের নিকোটিন ধমনী সংকুচিত করে দেয় এবং রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে তা পুষ্টি হ্রাস করে। ফলে ভ্রূণের মস্তিষ্ক কোষ উন্নয়ন ও স্নায়ুতন্ত্রের উন্নয়নের সমস্যা হয়। কোনো মা যদি শিশুর জন্মের পূর্বে ধূমপান করে তবে তাও শিশুর স্বাভাবিক মস্তিষ্ক উন্নয়নের বাধা সৃষ্টি করে। তাই শিশুর ভবিষ্যতের সমস্যা এড়ানোর জন্য গর্ভাবস্থায় তামাক এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকা উচিত।

অ্যালকোহল: গর্ভাবস্থায় মায়ের অ্যালকোহল পান ভ্রূণের মস্তিষ্ক গঠনে সমস্যা সৃষ্টি করে, এমনকি ভ্রূণের অ্যালকোহল সিনড্রোম রোগ হতে পারে। শিশু অনুন্নত মস্তিষ্কের সঙ্গে ছোট মাথা এবং স্থায়ী কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। এমনকি শিশুর কম আইকিউ, কম মনোযোগ, স্প্যান, কম জ্ঞানীয় দক্ষতা, কম স্মৃতি, মনোযোগে ঘাটতি, আবেগপ্রবণ আচরণ এবং দৈহিক অক্ষমতাসহ আরো নানা সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে পারে।

গাঁজা সেবন: যে মায়েরা গর্ভাবস্থায় গাঁজা সেবন করেন তাদের শিশু আচরণগত ও মানসিক সমস্যা, ভাষার অপূর্ণতা এবং স্মৃতি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

কোকেন: এ ড্রাগ শিশুর মাথার অস্বাভাবিক সঙ্কীর্ণতা (microcephaly) জনিত জটিল রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এতে মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য যে রুম আছে তা খুব ছোট এবং এই অপরিবর্তনীয় মস্তিষ্কের ক্ষতি মানসিক প্রতিবন্ধকতার ফলাফল। শিশুর মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তক্ষরণ ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। তাই গর্ভবতী মায়েদের কোকেন সেবন অনুচিত।

হেরোইন: হেরোইন সেবনকারী মা তাদের নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর দৈহিক ও মানসিক অক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তারা নিজেরা বিভিন্ন আচরণগত এবং সামাজিক রোগে ভোগেন ও শিশুদেরও সেই সমস্যায় ফেলেন।

বিভিন্ন মেডিকেশন ও কীটনাশক: গর্ভাবস্থায় অহেতুক ওষুধ সেবন অনুচিত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মৃগী রোগের জন্য ভালপ্রোয়েট (Valproate) গ্রহণ শিশুর কম আইকিউর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এসপিরিন শিশুর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। গর্ভাবস্থায় এসিটামিনোফেন ব্যবহার শিশুর মনোযেগে ঘাটতি সংক্রান্ত (Attention deficit hyperactivity disorder বা ADHD) জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। গর্ভবতী নারীদের, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে খুব সাবধানতার সঙ্গে ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

রুবেলা বা জার্মান হাম: মা গর্ভাবস্থায় রুবেলা বা জার্মান হামে আক্রান্ত হলে তাতে মায়ের উপর হালকা প্রভাব পড়লেও শিশুর ক্ষতি করে অনেক বেশি। শিশুর গুরুতর বিকলাঙ্গতা বা বিকৃতিসহ (malformations) গুরুতর মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।

খাদ্যে বিষক্রিয়া: গর্ভাবস্থায় কোনো নারী খাদ্যে বিষক্রিয়াজাত সমস্যায় সংক্রামিত হলে তা হয়তো তার ওপর হালকা উপসর্গ তৈরি করে, কিন্তু ভ্রূণের উন্নয়ন সমস্যাসহ শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধকতা, মৃগী রোগ, অন্ধত্ব, শ্রবণ ক্ষতি এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

দূষণ: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় বা জীবনের প্রথম বছর শিশুরা যদি ধোঁয়া এবং অন্যান্য বায়ু দূষণকারী পরিবেশে বড় হয় তবে তাদের বিভিন্ন দৈহিক অক্ষমতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি তাতে একটি শিশুর অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা দুই থেকে তিন গুণ বেশি থাকে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের অপর্যাপ্ত পুষ্টি ও অপ্রতুলতা: গর্ভাবস্থায় মায়ের সুষম খাবার, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে যা ভবিষ্যৎ শিশুর পাথেয়। ক্যালসিয়াম, আয়রন, আয়োডিন, ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য ভিটামিনের অভাব শিশুর শিক্ষণ অক্ষমতা, ভাষা উন্নয়ন এবং আচরণগত সমস্যা, দৈহিক দক্ষতা উন্নয়ন বিলম্বিত করতে পারে এমনকি শিশুটি অক্ষমতা নিয়ে জন্ম নিতে পারে।

যেমন আয়োডিন শিশুর থাইরয়েড হরমোনের জন্য প্রয়োজন, যা মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আয়রন শিশুর মস্তিষ্ক এবং শরীরের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তন ও আকৃতি বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়। অন্যদিকে শিশুর জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, আবেগ ও দক্ষতা অর্জনে সমস্যা সৃষ্টি করে।

সবুজ শাকসবজিতে প্রাপ্ত অ্যাসিডের অভাব: সবুজ শাকসবজিতে আছে পর্যাপ্ত এমাইনো এসিড যা শিশুর নিউরাল টিউব সঠিকভাবে গঠনে সহায়তা করে। নিউরাল টিউব মস্তিষ্কের বিকাশে অপরিহার্য। এই টিউব সঠিক ভাবে গঠিত না হলে মস্তিষ্কে গুরুতর বিকৃতি বাড়তে পারে।

শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বৃদ্ধি বা মনের বিকাশের উপরও নজর দিতে হবে। আর এ মানসিক বিকাশের জন্য বা মস্তিষ্কের উন্নয়নের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি অপরিহার্য। মায়ের পুষ্টি শিশুর পুষ্টি, আর সুষম খাদ্য মায়ের ও শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Previous articleখুব খুঁতখুঁতে বা শুচিবাইতা কি কোন রোগ?
Next articleএকদমই কথা শোনে না! কি করবেন?
প্রফেসর ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ
চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here