ডা. সাইফুন্নাহার
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
শের-ই বাংলা নগর, ঢাকা।
সারাবিশ্ব জুড়ে আধুনিক সমাজ যে গুরুতর সমস্যাগুলো মোকাবেলা করছে মাদকাসক্তি তার মাঝে অন্যতম। গত দুই দশকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে মাদকাসক্তের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মাদকাসক্ত নারীদের মাঝে শতকরা নব্বই ভাগই প্রজনন বয়সের। মাদকাসক্ত নারীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানা। অনেক গর্ভবতী নারী তাদের মাদকাসক্তির কথা গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছেও গোপন করেন। ফলে মাদকের উপর নির্ভরশীলতার লক্ষণগুলো অনেকক্ষেত্রেই শনাক্তকরণ সম্ভব হয় না এবং তাদের সঠিক নির্দশনা ও ব্যবস্থাপনা দেয়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় মাদক গ্রহণের ফলে গর্ভপাত, কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই শিশুর জন্ম, প্লাসেন্টা ছিঁড়ে যাওয়া, শিশুমৃত্যু, এমনকি মাতৃমৃত্যুর হারও বেড়ে যায়। নিম্নে গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন প্রকার মাদকের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
অ্যালকোহল (মদ, ব্রুজ, ব্রু, কোল্ডওয়ান, মুন শাইন, জিন, জুস, সস্, ভিনো, হার্ড-স্টাফ) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালকোহল অ্যান্ড অ্যালকোহলিসম্ এর তথ্যমতে, গর্ভাবস্থায় মা যদি খুব কমমাত্রায় অ্যালকোহলও গ্রহণ করেন তাহলে গর্ভস্থ শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়। কারণ, তা গর্ভপাত ঘটাতে পারে, শিশুর মাঝে ‘ফিটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম’ তৈরি করতে পারে; যা পরবর্তীতে তার মাঝে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক, মানসিক ও আচরণতগত সমস্যা তৈরি করতে পারে যা সারাজীবনব্যাপী থাকতে পারে।
সিগারেট
সিগারেটের মাঝে ক্ষতিকারক রাসায়নিক নিকোটিন থাকে যা শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এই নিকোটিন মায়ের যতটা না ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে শিশুর। কারণ, শিশুর রক্তে নিকোটিনের ঘনত্ব মায়ের তুলনায় শতকরা ১৫ ভাগ বেশি থাকে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ এবিউজ)। সিগারেট থেকে নির্গত নিকোটিন, টার, কার্বন মনোঅক্সাইড ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থসমস্যা যেমন: শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা, সেরিব্রাল পলসি, দৃষ্টি এবং শ্রবণের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এমনকি মা যদি সরাসরি ধূমপান নাও করেন কিন্তু তার চারপাশের পরিবেশে কেউ ধূমপান করে এবং পরোক্ষভাবে তা মায়ের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে শিশুর মাঝে বিভিন্ন প্রকার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেমন: জন্মের সময় ওজন কম হওয়া, ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম’ হওয়া ইত্যাদি।
কোকেইন (বাম্প, টুট, কোক, ক্র্যাক, ফ্লেক, স্নো, ক্যান্ডি)
যেসব মা কোকেইন সেবন করেন তাদের পুষ্টিহীনতায় ভোগেন এবং তারা গর্ভস্থ সন্তানের পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে পারেন না। তাদের মাঝে কোকেইন এর সাথে অন্যান্য মাদক (যেমন: অ্যালকোহল) গ্রহণের প্রবণতা বেশি থাকে। ফলে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতির জন্য কোনো মাদকটি দায়ী তা যথাযথভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। কোকেইন সেবনকারী গর্ভধারিণীর মাঝে উচ্চ রক্তচাপ, খিচুনি, মাইগ্রেন, জরায়ু থেকে প্লাসেন্টা ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার জটিলতা তৈরি করতে পারে যা গর্ভস্থ শিশুর পূর্ণতা প্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে গর্ভপাত, ৩৭ সপ্তাহের আগেই শিশুর জন্ম বা অপরিণত শিশুর জন্ম, কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে। তাছাড়া শিশুর মাঝে উচ্চরক্তচাপ, খিঁচুনি, এমনকি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
হেরোইন (হোর্স, স্ম্যাক, জাক, এইচ-স্টাফ)
গর্ভাবস্থায় শেষ তিন মাসের সময় হেরোইন সেবন করলে মায়ের রক্তপাত, উচ্চ রক্তচাপ এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রথম তিন মাসের সময় সেবন করলে অপরিণত, কম ওজন সম্পন্ন শিশুর জন্ম, শিশুর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব অথবা জন্মের পর শিশুর মুত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়। হেরোইনের আসক্তি তৈরির ক্ষমতা এত বেশি যে তা গর্ভস্থ শিশুকেও হেরোইন এর ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। তাছাড়া ‘নিওন্যাটাল এবসস্টিন্যান্স সিনড্রোম’ বা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতকের মাঝে হেরোইনের প্রত্যাহারজনিত সমস্যা যেমন: অতিরিক্ত কান্নাকাটি, অস্থিরতা, বিরক্তি, হজমে সমস্যা, খাওয়ায় অরুচি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
মারিজুয়ানা (পট, উইড, গ্রাস, রিফার)
প্লাসেন্টার মাধ্যমে শিশুর শরীরে গ্রামে মায়ের শরীর থেকে মারিজুয়ানা বরাহ কমিয়ে দেয় এবং তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। যেমন: নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জন্ম হওয়া, জন্মওজন কম হওয়া, বিরল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া, মনোযোগে সমস্যা, সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, পড়ালেখায় খারাপ করা ইত্যাদি।
এক্সট্যাসি/এমডিএমএ/ক্রিস্টাল
এগুলো উত্তেজনা সৃষ্টিকারক ড্রাগ যা ট্যাবলেটের আকারে বিক্রয় করা হয়। গুঁড়ো করে মাড়িতে লাগানো হয় বা নাক দিয়ে টেনে নিতে হয়। দীর্ঘ সময় গ্রহণ করলে স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, পানিশূন্যতা, বৃক্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস মা এটি গ্রহণ করলে তার শিশুর মাঝে স্মরণশক্তির সমস্যা, চলাফেরা ও কাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া রক্তনালী, হৃদযন্ত্র, হাড় ও মাংসপেশিতে ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মিথামফিটামিন (মিথ, স্পিড, গ্লাস, ক্র্যন্ক)
এটি গর্ভাবস্থায় গ্রহণ করলে কোকেইন সেবীদের এর মতো অনুরূপ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া নবজাতকের মাঝে এর প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ যেমন: শরীর কাঁপা, নিদ্রাহীনতা, মাংসপেশিতে টান, খাদ্যগ্রহণে অরুচি দেখা দিতে পারে। কারো কারো মাঝে পরবর্তীতে বুদ্ধি-প্রতিবন্ধকতাও দেখা দিতে পারে।
ব্যথা নিরাময়কারী ঔষধ
ওপিওয়েড/মরফিন জাতীয় ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ গর্ভাবস্থায় সেবনের ফলে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কে তরলের চাপ (CSF presure) বৃদ্ধি, হৃদযন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি, পেটের মাংসপেশিতে সমস্যা, গ্লুকোমা ইত্যাদি তৈরি হতে পারে। তাছাড়া হেরোইন এর মতো এগুলোও ‘নিওন্যাটাল অ্যাবসস্টিন্যান্স সিনড্রোম’ তৈরি করতে পারে। মাদক গ্রহণ এবং মাদকের ওপর নির্ভরশীলতা বা আসক্তি কোনো কালে, কোনো দেশে, কোনো বয়সের নারী/পুরুষের ক্ষেত্রে কাম্য নয়। গর্ভাবস্থায় তো আরো নয়। কারণ তা মা এবং শিশু উভয়ের জীবনকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে। তবে কেউ যদি গর্ভধারণের পূর্বে আসক্ত থাকেন অথবা গর্ভধারণকালীন আসক্ত হয়ে পড়েন তাদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা রয়েছে। ঔষধ, সাইকোথেরাপি, পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে মাদকমুক্ত হতে সহায়তা করা যায়, সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর জন্ম দানকে উৎসাহিত করা যায়; মা এবং ও সুস্থ মাঝে মাদকের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিচিত থাক কমানো যায়। তাই চিকিৎসকের কাছে করে মাদকগ্রহণের বিষয়টি খুলে বলা উচিত, চিকিৎসকের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন।