সুস্থ বিনোদন বা খেলাধুলার সুযোগ না থাকার সাথে আসক্তির সম্পর্ক

সুস্থ বিনোদন বা খেলাধুলার সুযোগ না থাকার সাথে আসক্তির সম্পর্ক

আশাহত, ভগ্ন হৃদয়ে আজ বান্ধবী শাকিলা’র বাসায় এসেছেন রাহেলা। ছোট্টবেলার প্রাণের বন্ধু দুজন। তবে আজ বন্ধুতা করতে নয়, একজন পরাজিত মা হিসেবে এসেছেন একজন “সাইকিয়াট্রিস্ট” শাকিলার কাছে।

পাশের কোন বিল্ডিংয়ের পাশ থেকে অস্থায়মান সূর্যটা জানান দিচ্ছে তার অবস্থান।সেদিকে তাকিয়ে ভাবছেন রাহেলা গত ক’দিনের কথা।

তার তের বছরের ছোট্ট ছেলে মাদকাসক্ত!

তার ঘরে ইয়াবা ট্যাবলেট, আর কি কি যেন পাওয়া গেছে! কিভাবে পেল, কার কাছে….এগুলো নিয়ে ভাবতে পারছেন না তিনি!

তার তের বছরের বাচ্চা নিমো! এটাও কি সম্ভব!

আর ভাবতে পারেন না তিনি, বসে পড়েন বারান্দার লম্বা চেয়ারটাতে।

এই যেন সেদিন জন্ম হলো নিমোর! বড় ছেলে নিশোর প্রায় চৌদ্দ বছর পর জন্ম তার।তের তে পড়লো মাত্র। গত কয়েকমাস ধরেই খেয়াল করছেন সে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে না,তার রূমের বাইরেও কম বেরুচ্ছে, কিছু বললে বিরক্ত হচ্ছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে।প্রথমে ভেবেছেন, হয়তো ক্লাস হচ্ছেনা, তাই যাচ্ছে না। সমস্যা নেই,যাবে।রাহেলা অন্যান্য মায়েদের মত বাচ্চাদের ওপর পড়াশোনার বেশী চাপ দেয়ার পক্ষপাতী নন। তাছাড়া নিজেও কিছুটা ব্যস্ত সমাজ সেবা মূলক কাজ নিয়ে। বড় ছেলের মত ছোট টাকে ওতটা সময় দিতে পারছেন না।ভেবেছিলেন বড় ভাইকে দেখে ছোটজন ও তার মত পড়ুয়া, সামাজিক, তুখোড় বিতার্কিক বা বক্তা হবে। কিন্তু সে আশা বাদ দিয়েছেন কয়েক বছর আগেই, যখন থেকে খেয়াল করলেন নিমো কথা কম বলে, নিজের মত করে থাকতে ভালোবাসে, আর সবার সাথে মিশতেও চায় না। অবশ্য উনি নিজেও যে খুব চেষ্ট করেছেন ছেলেকে চেঞ্জ করার, তা নয়। রাহেলা ধরে নিয়েছিলেন নিমো ওরকমই,তাকে চেঞ্জ করার চেস্টা করা হলে, সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে। খেলাধুলার জায়গা নেই আশেপাশে, তাই ছোট থেকেই বাসার কম্পিউটারেই গেইম খেলতো সে বিকেল বেলায়…এটাতেও আপত্তি ছিলোনা রাহেলা বা তার স্বামীর, যেহেতু সব বাচ্চারাই খেলে ‘কম্পিউটার গেম’। পরে বায়না ধরলে ট্যাব কিনে দেন। ট্যাব কিনে দেয়ার পর থেকেই আস্তে আস্তে ছেলেটা বদলে যেতে শুরু করলো, আগে উনার রুমে এসে কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ট্যাবে গেইম এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের পর থেকে তার রূম থেকে কমই বের হত। মোবাইল বা ট্যাব সরিয়ে নিলে রেগে উঠতো। মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে একটু বিরক্ত যে হননি, তা নয়। কিন্তু ভেবেছেন ছেলের যেহেতু বাইরে খেলাধুলার সুযোগ নেই, বরং মোবাইলেই খেলুক। কিন্তু সেটা যে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি!

এই তো, মাত্র দু-তিন দিন আগেই জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকরতম সত্যের মুখোমুখি হলেন তিনি!পরশু দিন বাসায় ঢোকার সময় গেট থেকেই শুনতে পান চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। শব্দের উৎস বুঝে দৌঁড়ে বাসায় নিমোর রূমে ঢুকে দেখেন লন্ডভন্ড অবস্থা ঘরের। রাহেলার স্বামী ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, নিমো চিৎকার করছে….সামনে রাগী চেহারায় দাঁড়িয়ে নিমো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে করতে অনেক্ষন পরে যে উত্তর পাওয়া গেলো, তাতে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন রাহেলা।

“কি ভাবছিস?”- চমকে ওঠে তাকিয়ে দেখেন শাকিলা দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবেলার বান্ধবীকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন তিনি। শাকিলার চোখেও অশ্রু।

বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে বন্ধুর পাশে বসলেন তিনি। রাহেলা বুঝলেন কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন শাকিলা। তিনি শুনতে লাগলেন।

‘তুই শুনেছিস নিশ্চয়ই ‘নাইন্টিজ এর চাইল্ড’ নামে একটা কথা আছে। সম্ভবত এই নাইন্টিজের সময়ের শিশু- কিশোর গুলোই সবচেয়ে শেষ প্রজন্ম, যারা মাঠে- ঘাটে হেসে-খেলে কিছুটা বড় হয়েছে। এর পর থেকেই প্রযুক্তি আর ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ঘিরে ধরেছে শহরবাসীদের। ফলে ২০০০ সাল, বা তারপরে জন্ম নেয়া শিশুরা আগের প্রজন্মের মত চাইলেও ওভাবে আর খেলতে পারেনি, ঘুরতে পারেনি। কারণ খেলার জায়গা কমে যাওয়া ছাড়াও আজকালকার বাবা-মা বাচ্চাদের পড়াশুনার প্রতি বেশী সচেতন হয়ে যাওয়ায় পড়াশুনা ছাড়া বাকি সব কিছু, যেমনঃ খেলাধুলা বা অন্যান্য একটিভিটিস কম গুরুত্ব পেয়েছে। বাইরে খেলার চেয়ে মোবাইল বা কম্পিউটারে খেলা বা সময় দেয়াটা অনেকেই বাচ্চার জন্য অধিক ভালো বলে মনে করেন বা করতেন তারা।

নিমো নেশা করে।ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবেই ভয়ংকর, কিন্তু সেটার পটভূমিটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তোরা যখন কম্পিউটার বা ট্যাব দিয়েছিলি,কি ভেবেছিলি? ভেবেছিলি বাচ্চা ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে, বা মোবাইল গেইমটা খেললো, তো বাসায়ই থাকলো, দুস্টামি করলো না?’

রাহেলা হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে বাকিটা শুনার অপেক্ষায় থাকলেন।

‘খেলাধুলা – অন্যান্য একটিভিটিতে না থেকে দীর্ঘদিন শুধু বসে বসে কম্পিউটারে গেইম বা অন্য কাজ করার ফলে শরীরবৃত্ত্বীয় কি সমস্যা হয় সেটা অনেকেই জানে। যেমন স্থূলত্ব, ডায়াবেটিস, দূর্বল হাড়ের সমস্যা ছাড়াও সামাজিক না হওয়া, ঘুম কম হওয়া, বিরক্তি, আচরণগত সমস্যা এবং অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেয়। তুই জেনে কিছুটা অবাক হবি, কিন্তু এটা সত্য যে ইন্টারনেট/সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি বা ইন্টারনেট গেমিং আসক্তির সাথে নেশার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে।

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তির সাথে নেশাদ্রব্য গ্রহনের ঝুঁকি জড়িত।ইন্টারনেটে আসক্তি এবং মাদকাসক্তি একই সূত্রে গাঁথা। কারণ, যে কোনো আসক্তিতে মস্তিষ্কে reward pathway উজ্জীবিত হয়, এতে মস্তিষ্কে “ডোপামিন” নামক যে রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় তা আনন্দের অনুভূতি (pleasurable sensation) দেয় এবং ঐ আচরণগুলোকে পুনরাবৃত্তি করতে অনুপ্রাণিত করে।’

একটু নড়েচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন শাকিলা-‘জানিনা, তোকে আমি কতটুকু বোঝাতে পারলাম,তবে বলার উদ্দেশ্য এটাই ছিলো, আজকে নিমোর মাদকাসক্তির সাথে তার ইন্টারনেট গেমিং এর কোনো ভূমিকা আছে কি না…সেটা কিছুটা বোঝানো।

অনেক তো বললাম, এবার বল তো এই ইন্টারনেট আসক্তি, এই নেশা করা, কোথা থেকে বা কেন এর উৎপত্তি? ভেবে দেখ, ইট-পাথর-আর কনক্রিটের দেয়ালে বাচ্চাদের ছোটবেলাটা আটকে ফেলেছি আমরা।পড়াশোনা আর প্রযুক্তির চাপে, নগরায়নের ফাঁদে পিষ্ট বাচ্চাগুলো হারিয়ে ফেলেছে তাদের দুরন্ত শৈশব। আমরা ভুলেই গেছি একটা বাচ্চার ভবিষ্যৎ শুধু পড়াশুনা করে নয়, তার পাশাপাশি খেলাধূলা, বিনোদন, গল্পের বই পড়া,ঘুরে বেড়ানো….সব কিছু মিলেই একটা শিশুর প্রকৃত বেড়ে ওঠা হয়।

তবে সময়টা এখনও হারিয়ে যায়নি, তার শৈশব এখনো ফিরে পাওয়ার সুযোগ আছে। তুই নিমোকে নিয়ে আয় কাল-পরশু। তার বর্তমান অবস্থা দেখে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। আর তোরা, মানে তার পরিবারই কিন্তু পারে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে।

রাহেলা এতক্ষণ গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন শাকিলার কথা। যেন ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বের হয়ে গেলেন।

শাকিলা তাকিয়ে থাকলেন তার প্রিয় বন্ধুটির দৃপ্ত পদক্ষেপের দিকে। তিনি জানেন রাহেলা অবশ্যই পারবে তার সন্তানকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে, পারবেন এক দূরন্ত কৈশোর উপহার দিতে।
সময়টা যে এখনও সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যায়নি!

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম: পরস্পরের প্রতি মনোভাব এবং প্রভাব বিষয়ে জরিপ চলছে
Next articleনিউরোসাইকিয়াট্রিক রোগীদের জন্য করোনা ভাইরাসের টিকা বিষয়ক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here