কেমন হবে একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র?

কেমন হবে একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র?

মানবসমাজে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মাদকের ব্যবহার ছিল। সেই তখন থেকেই যখন কৃষকগণ আবিষ্কার করলেন যে ফল বা ফসল গেঁজানোর ( ফারমেন্টেশন) পর তা সেবন করে অপ্রত্যাশিত সুখানুভূতি পাওয়া যায়। এই অভিজ্ঞতা তাদের বারবার এধরনের দ্রব্য সেবনের দিকে উৎসাহিত করে, এভাবেই মাদকাসক্তির শুরু। মাদকাসক্তি যে একটি রোগ এ ধারনা গবেষকদের থাকলেও সমাজের সাধারন মানুষ একে নৈতিক বিচ্যুতি বা স্খলন বা অপরাধ হিসেবেই গন্য করতেন (বা এখনও হয়তো অনেকেই করেন)। ফলে এর জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ছিল- বন্দী করা, পাগলা গারদে পাঠানো, এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য নেয়া। এখন আমরা জানি যে, মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ; আরও নির্দিষ্ট করে বললে মস্তিস্কের রোগ (Brain Disease)। কাজেই অন্যান্য রোগের মতই এর চিকিৎসা প্রয়োজন। মাদকাসক্তির চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বলতে সাধারন ভাবে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র (Rehab center) গুলোকেই বুঝে থাকেন।

ইতিহাস ঘেঁটে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন কাল থেকেই আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে মদ্যপান প্রচলিত ছিল, কিন্তু তা ছিল শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসেবেই। কেবল সুখানুভূতির জন্য লাগামহীনভাবে মদ্যপানের ধারনা তাদের ভেতর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা প্রবেশ করিয়েছিল। অতিরিক্ত মদ্যপান নিয়ন্ত্রনের কোন উপায় সেই আদিবাসীদের জানা ছিল না। তারা তাদের জমি-জমা, সম্পদ এর বিনিময়ে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে পরিশোধিত  উন্নতমানের মদ সংগ্রহ করা শুরু করল। এক পর্যায়ে গোত্র প্রধানগণ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের ষড়যন্ত্র বুঝে ফেলেন এবং তরুণদের এই নেশার কব্জা থেকে ফিরিয়ে আনতে তারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও কৃষ্টির চর্চায় মনোনিবেশে উৎসাহিত করেন, তারা এর নামকরন করেন “Sobreity Circle”। এই চক্রের উদ্দেশ্য ছিল সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে নিজের থেকে উচ্চতর শক্তির নিকট আত্মসমর্পণ ও সাহায্য প্রার্থনা করা ( উল্লেখ্য বিংশ শতকের জনপ্রিয় Alchoholic Annonymus এর পদ্ধতিও তাই)। এমন কি  Alchoholic Annonymus তাদের প্রতিকেও প্রাচীন  Sobreity Circle এর চিহ্ন ধারন করেছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম স্থপতি, বিখ্যাত চিকিৎসক বেঞ্জামিন রাস মনে করেতেন মদ্যাসক্তি প্রকৃতপক্ষে নৈতিক সমস্যা নয়, বরংমদ্যপানের ব্যাপারে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা, এটা মদের রাসায়নিক গুণ। তিনি মনে করতেন মদ্যাসক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, যার নিরাময়ে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রয়োজন। বেঞ্জামিন রাস সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় Sober House প্রতিষ্ঠা করেন, এখানে আসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা হত যতদিন না তারা সমাজে পুনর্বাসিত হবার পর্যায়ে উপনীত হন। এটাই ইতিহাসের প্রথম মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। এতো গেলো বিশ্ব ইতিহাস, ভারতীয় উপমহাদশেও প্রাচীনকাল থেকেই মাদকের প্রচলন  ছিল।

উপমহাদেশের প্রাচীন ধর্মগুলোতেও ধর্মীয় আচার হিসেবে মাদক, বিশেষকরে গাঁজা এর ব্যবহারের প্রমান পাই। তবে এই সমাজের মূল্যবোধ ও কাঠামোর প্রভাবে এই আসক্তি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় নি। এখানে মাদকাসক্তি সমস্যা হিসেবে হাজির হয়, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের সাথেই। দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বাংলাদেশে মাদকাসক্তি সমস্যা হিসেবে আসে স্বাধীনতার একদশকেরও বেশি সময় পর। এ সময়ই প্রথম এদেশের তরুন সমাজ দেশীয় মাদক ( যেমনঃ গাঁজা, আফিম, ভাং ইত্যাদি) এর পাশাপাশি হেরোইন, কোকেন, ফেনসিডিল ইত্যাদির সাথে পরিচিত হতে শুরু করে, এবং দ্রুতই এসবে আসক্ত হয়ে পড়ে। এদেশে মাদকাসক্তি নিরাময় বা পুনর্বাসন কেন্দ্রের শুরুও প্রায় এসময় থেকেই। একেবারে প্রথম দিকে এসব কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল মুলতঃ পুনর্বাসিত আসক্তদের (Recovered Addict) দ্বারাই। ১৯৮৮ সালে প্রথম সরকারী ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপিত হয় ঢাকার তেজগাঁয়ে। পরবর্তীতে একে একে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতেও এধরনের সরকারী নিরাময়কেন্দ্র স্থাপিত হয়।

মাদকাসক্তির চিকিৎসা পদ্ধতি বিবর্তন অনুযায়ী দুইভাগে ভাগ করা যায়: ১) নৈতিকতা মডেল (মরাল মডেল) ; ও ২) মেডিকেল মডেল। নৈতিকতা মডেল গতানুগতিক ধ্যান-ধারনা প্রসূত। এই চিকিৎসা পদ্ধতি মতে, মাদকাসক্তি একপ্রকার  নৈতিক বা চারিত্রিক স্খলন, এমনকি অপরাধ। ফলে এর চিকিৎসা পদ্ধতি সংশোধন মূলক (Correctional)। এ সম্পর্কে আগেই বলেছি। এই কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্রগুলো এই দর্শনে পরিচালিত হচ্ছিল। এসব কেন্দ্রে ধর্মীয় আচার পালন ও রোগীদের দীর্ঘসময় সীমিত গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা এই ছিল এসব কেন্দ্রের চিকিৎসা পদ্ধতি। মাদকাসক্তি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ ও পুনঃ আসক্তি প্রতিরোধ এর কোন সুযোগ থাকতো না। এমনও জানা যায় কখনও কখনও প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ দেখা দিলে কোথাও কোথাও বেঁধে রাখা, ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো, বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহন করা হতো। কোন ধরনের জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন হলে তাৎক্ষনিক চিকিতসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা থাকতো না। পরবর্তীতে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিরাময়কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করে। সেই অনুসারে চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট এদেরকে মাদকাসক্তির চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন এনজিও,দাতব্য সংস্থা,ব্যক্তিগত উদ্যোগে আধুনিক মাদকাসক্তি কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ প্রদান ও তদারকির কাজটি করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’ ও মানসিক স্বাস্থ্য আইন বলবত হওয়ায় মাদকাসক্তির চিকিৎসায় গুনগত পরিবর্তন হবে বলেই বিশেষজ্ঞগনের ধারনা।

একটি আদর্শ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের কোন সর্বজন স্বীকৃত মডেল নেই। তবে কেন্দ্রের মাদকাসক্তি রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীর প্রয়োজন পূরণের সক্ষমতা থাকতে হবে। মাদকাসক্তির সংজ্ঞা অনুসারে, একজন মাদকাসক্ত, সবসময়ই একজন মাদকাসক্ত অর্থাৎ একবার যে মাদকাসক্ত হল তার পুনঃ আসক্তির ঝুঁকি সবসময় থাকে। একারনেই মাদকাসক্তির সুস্থতাকে(Recovery) বলা হয় একধরনের চলমান প্রক্রিয়া(Continuous Process)। তাহলে মাদকাসক্তির চিকিৎসা কেন্দ্রে এই চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাদকাসক্তির মডেল অনুসারে সাধারণত একজন মাদকাসক্ত শুরুতেই তার অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী থাকেন না । তাই ঐ পর্যায়ে তার পুনর্বাসন (Rehabilitation) চিকিৎসা শুরু করাটা ফলপ্রসূ হবে না। তাই একটি নিরাময় কেন্দ্রে বহির্বিভাগ ও অন্তঃ বিভাগ থাকবে। বহিবিভাগে মাদকাসক্তকে চিহ্নিত করা, তাকে পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা গ্রহনের জন্য উৎসাহিত করা, কম ক্ষতিকর পদ্ধতি অনুসরন করা, মাদকাসক্তের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা প্রদান, ঝুঁকি পূর্ণ মাদকের ব্যবহার হ্রাস করা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে। অন্তঃ বিভাগে রোগী ভর্তি থেকে সেখানে নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করবে তার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে। এসময় মোটামুটি দীর্ঘ হবে (প্রায় ৩ মাস)। এছাড়া থাকবে জরুরী বিভাগ। অন্তঃ বিভাগে রোগীর প্রয়োজন অনুসারে শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা, প্রত্যাহার জনিত উপসর্গের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া পুনঃ আসক্তির প্রতিরোধ কৌশল, স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণ পদ্ধতি ইত্যাদি শিক্ষা দিতে হবে। মাদকাসক্তদের সাধারনত সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি থাকে এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো ইত্যাদির জন্য সাইকলজিকাল চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাদকের পরিবর্তে সুস্থ বিনোদন ও খেলা ধুলার মাধ্যমে আনন্দলাভের ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকাটাও অত্যন্ত জরুরী। মাদকাসক্তের সমাজে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন সহজ করতে নিয়মিত ফলোআপ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রগুলো নিয়ে সমালোচনা নেহাত কম নয়। চিকিৎসার নামে আটকে রাখা সহ , বিভিন্ন সময় নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার খবরও অতীতে পাওয়া গেছে। মাদকাসক্তির চিকিৎসার বড় অসুবিধা হল এর ব্যয় ও দীর্ঘসূত্রিতা। বেসরকারি পর্যায়ে এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করা, অধিকাংশ মানুষের জন্যই দুঃসাধ্য। কাজেই সরকারী পর্যায়ে এই চিকিৎসার কলেবর বাড়ানো সময়ের দাবী। এর পাশাপাশি তদারককারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাদকাসক্তির চিকিৎসার নামে অপচিকিতসা প্রদান কারি প্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleশিশুদের পটি ট্রেইনিং: আদ্যোপান্ত
Next articleকরোনা আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন: গবেষণা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here