‘ম্যাডাম আমার মেয়েকে ভালো করে দিন। ওকে ভালো করতে যা করতে বলেন করব।’ বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই ধরনের অনুরোধের সম্মখীন আমরা সবাই হই। এমন একটা বিশ্বাস নিয়ে রোগীর আত্মীয়- পরিজন আসেন যে আমরাই তাদের সমস্যা জাদুর মতো করে সমাধান করে দেব। কিন্তু সব সমস্যা যেমন সমাধান করা সম্ভব না তেমনি সব মানসিক রোগও পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে চিকিৎসাতে অবশ্যই উন্নতি হয়।
সেদিন ফুটফুটে একটা সন্দর মেয়ে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন বাবা-মা। ঢুকেই অনুরোধ করতে লাগলেন। আমি বললাম, “বসুন, তারপর বিস্তারিত বলুন যে আপনার মেয়ের কি সমস্যা?” বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু মা উনাকে থামিয়ে নিজেই বলতে লাগলেন, ‘ম্যাডাম আমার মেয়ে নুসরাত, তার অটিজম ভালো করে দিন।’ আমি বললাম, ‘এই অটিজমের জন্য নুসরাতের কী কী সমস্যা হচ্ছে?’ মা আবার বললেন, ‘ও তো অটিস্টিক চাইল্ড, এটাই সমস্যা আর কোনো সমস্যা নেই।’ সাথে সাথে নুসরাত বলল, ‘মা ঠিকই বলেছে- আমি অটিস্টিক। আমি কিছু পারি না। সালামালাইকুম তুমি কেমন আছ? তুমি আমাদের বাসায় এসো। মা, ডাক্তারের সাথে কথা শেষ এবার চলো বাসায় যাই। বাবা ওঠো চলো।’
‘দেখেন দেখেন ডাক্তার ওর কথাগুলো স্পষ্ট না। এমনিতে সব ভালো কিন্তু কিছু পছন্দ না হলে জিনিস ছুঁড়ে দেয়। অপরিচিত লোকদের ধরতে যায়, কাউকে পছন্দ না হলে তাকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে যায়, ভালো করে সব কাজ গুছিয়ে করতে পারে না। ওর বয়স ১২ কিন্তু পড়ে ক্লাস ফোরে। অংক ও ইংলিশে খুব কাঁচা। কিন্তু নামাজ পড়তে পারে। এখন প্রায় প্রতিদিনই খুব অস্থির করে এবং আমাদের বিরক্ত করতে থাকে। ও ভালো হবে তো?’
এতক্ষণ কথা শোনার পর আমি শুধু জানতে চাইলাম, কে শনাক্ত করেছে যে নুসরাত অটিজম রোগে ভুগছে। সাথে সাথে মা-বাবা বলে উঠলেন, ‘ঐ যে পত্র- পত্রিকাতে, টিভিতে বলতে থাকে এ ধরনের বাচ্চারা অটিস্টিক এবং এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এমনকি অটিজম ভালো করার জন্য স্কুলও আছে।
আমাদের এমন একটা স্কুলের সন্ধান দিন প্লিজ।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার জন্য এমন একটা স্কুলের ঠিকানা দিন তো ডাক্তার আন্টি।’
আসলে এরকম অনেক নুসরাতকে নিয়েই মা-বাবা অটিজম ভাবতে থাকেন এবং নিশ্চিত হন। অটিজমের প্রচার অন্যসব শিশু বিকাশজনিত সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। তার জন্য শিশুদের বুদ্ধিমত্তার অন্য রোগগুলো সম্পর্কেও সচেতনতার দরকার। অটিজম সারা বিশ্বে শতকরা ০.৫ ভাগ। অথচ অন্যান্য মানসিক প্রতিবন্ধী শতকরা ১০ভাগ। যদিও বদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম দটিই মনোবিকাশগত জটিলতা। ১৯৪৩ সালের অটিজম রোগটি সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিল না। জন ডা. লিও কান্নে ও প্রায় একই সময় জার্মান বিজ্ঞানী ডা. হ্যান্স এসপারগার রোগটি সম্বন্ধে ১৯৪৩ সালে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে অটিজম নিয়ে প্রচুর গবেষণা, প্রচার ও চিকিৎসা হচ্ছে। অটিজম একটি মারাত্মক স্নায়-মনোবিকাশজনিত জটিল রোগ যার সনির্দিষ্ট কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ, মস্তিষ্ককের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগতির অস্বাভাবিকতা এমনকি বিভিন্ন টিকার প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি থেকেও এই রোগটি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জন্ম পরবর্তীকালের কোনো জটিলতা বা অযত্ন থেকে এ
রোগের উৎপত্তি হয় না।
আমাদের দেশে সঠিক তথ্য না থাকলেও গড়ে প্রতি হাজারে ১০ থেকে ২০টি শিশু এই রোগে আক্রান্ত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এবং উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা আরো বেশি বলে ভাবা হচ্ছে। যাই হোক নুসরাতের কথা বলছিলাম। আমি তার মা- বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তার কোনো শারিরীক ও প্যাথলোজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে কিনা? সাথে সাথে তারা বলে উঠলেন, ‘কী যে বলেন! সব পরীক্ষা করিয়েছি, অনেুকবার করে। কিন্তু সব রিপোর্ট ঠিক। শুধু আই কিউ-এর রিপোর্টটা একটু কম। অটিজমে তো ঐটুকু কম হতেই পারে।’ আসলে অটিজমে প্যাথলজিক্যাল কোনো সমস্যা পাওয়া যায় না এবং এরকম অনেক বাচ্চারই আই কিউ খুব ভালো থাকে। আসলে নুসরাত অটিজমে না সে ইন্টালেকচুয়াল ডিজএ্যাবিলিটি মানে মানসিক বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতাতে ভুগছে। অটিজম সম্পর্কে প্রচার ও প্রসারের জন্য সব বাচ্চাদের মধ্যে সবাই অটিজম খুঁজে বেড়ায় আর সেজন্য ভুল ডায়াগনোসিসও হচ্ছে- সেই সাথে ভুল চিকিৎসা।
ইনটালেকটুয়াল ডিজএ্যাবিলিটি ও অটিজম দুটোই নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। জন্ম থেকেই এই রোগগুলো থাকে কিন্তু তাদের ডেভলপমেন্টাল মাইলএসটন বা বয়সের সাথে সথে মানসিক বিকাশ বিলম্ব হয়। অটিজমে প্রধানত তিনটি সমস্যা দেখা যায়। যেমন- মৌখিক কিংবা কোনো যোগাযোগে সমস্যা, সামাজিক বিকাশগত সমস্যা, খুব সীমাবদ্ধ ও গন্ডিবদ্ধ জীবন-যাপন ও চিন্তা-ভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ। শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে ৩বছরের মধ্যে অটিজম দ্ব্যর্থহীনভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। অটিজম ছাড়া অন্য স্নায়ু-মনোবিকাশজনিত রোগগুলোতে শিশুর অন্য মানুষের সাথে মিশতে ও সামাজিকতা বজায় রাখতে কোনো সমস্যা হয় না। যদিও ভাষাগত সমস্যা ও ভাষার বিকাশে বিলম্ব হতে পারে। তাদেরকে নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় এবং চোখে চোখ রেখে তাকায় ও কথা বলে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না, অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না বা আদর করলেও সাড়া দেয় না। একই কথার পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বার বার করতে পছন্দ করে। আশেপাশের ও পরিবেশের পরিবর্তন পছন্দ করে না এবং বিরক্ত হয়ে যায়। সব সময় অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ ও বাড়তি যত্ন নিতে হয়।
ইনটেলেকচুয়াল ডিজএ্যাবিলিটির ক্ষেত্রে শিশুর আই কিউ ৭০-এর নিচে থাকে তাই বিকাশ দেরিতে হয়, সঠিক সময়ে কথা বলতে, বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে শেখে না। অন্য স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শিশুদের চেয়ে যে-কোনো কিছু আয়ত্ত করতে, যে-কোনো সমস্যা সমাধান করতে অনেক দেরিতে শেখে এবং ভুলে যায় তাড়াতাড়ি। বুদ্ধি খাটিয়ে যে-কোনো কাজ সুচারুরূপে করতে পারে না। বুদ্ধিমত্তার কমতি হওয়াতে স্বাভাবিক জৈবিক কাজগুলো ভালোভাবে অন্যের পরামর্শ ছাড়া করতে পারে না। অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, তাই একা থাকতে পছন্দ করে। তাদের ভেতর ইমোশনাল বহিঃপ্রকাশ আছে, সামাজিক বিষয়গুলো বজায় রাখতে পারে না, ভালোবাসতে ও ভালোবাসা দেখাতে পারে না। অন্যের সহায়তায় অনেক কিছুই করতে পারে। তাদের অটিস্টিক শিশুদের মতো বিশেষ চিকিৎসার ও প্রশিক্ষণদরকার। সবার আগে দরকার এর জন্য জনসচেতনতা- শিশু কোন রোগে ভুগছে তার সঠিক চিহ্নিতকরণ। অটিজমের চেয়ে এই রোগের প্রকোপ বেশি তাই দ্রুত শনাক্তকরণের মাধ্যমে চিকিৎসার আওতাভুক্ত করা জরুরি।
সামাজিক সচেতনতামূলক উদ্যোগ যেমন- রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা, সভাসহ বিভিন্ন প্রচার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ চিকিৎসার সুব্যবস্থা ও পুর্নবাসন খুব প্রযোজনীয়। তাদেরচিকিৎসার সাথে সাথে অবশ্যই পরিবারের লোকসহ শিক্ষকদের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ যত্ন, বিশেষ স্কুল, ইনস্টিটিউট, বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিশেষ মনোভাবের সুবন্দোবস্ত করলে ওদের উন্নতির সাথে সাথে দেশেরও উন্নতি হবে। বিশেষ ব্যবস্থাতে বিশেষ শিশুদের ভবিষৎ উজ্জ্বল করা সম্ভব। তাই বা কম কী! প্রতিটি শিশুই বেড়ে উঠুক সমঅধিকারে উজ্জ্বল আগামীর বার্তা নিয়ে।