করোনা মহামারি মনের ওপর প্রভাব

করোনা মহামারি মনের ওপর প্রভাব

বিশ্ব তার নিজস্ব গতিতেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন এর গতির চাকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল অতি ক্ষদ্রু একটি ভাইরাস যা চোখে দেখা যায় না। চীনের উহান প্রদেশে শুরু হওয়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসটির আক্রমণে একে একে বন্ধ হতে থাকল যোগাযোগ ব্যবস্থা, কলকারখানা, অফিস-আদালত। আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল মানুষের চলাফেরা। মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ল তার নিজ বাড়িতেই। রোগের প্রাদর্ভুাব এতটাই বেড়ে গেল যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘করোনা মহামারি’ ঘোষণা করতে বাধ্য হলো।

প্রতিটা দেশ মানষুকে ঘরে রাখতে নানাবিধ আইনের প্রয়োগ করতে শুরু করল। শুধু তাই নয়, অন্যান্য দেশ হতে আগত প্রবাসীরাও নিজ ঘরে যেতে পারল না সহজেই। এয়ারপোর্টে পৌঁছোনোর পরপরই থেকে যেতে হলো সরকার নির্ধারিত স্থানে ১৪ দিন পর্যন্ত।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সরকারও নানাবিধ পদক্ষেপ নিতে শুরু করল। আর এসব পদক্ষেপ নেয়ার পর থেকেই কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং নামক প্রায় নতুন কিছু শব্দ আমাদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করা শুরু করল।

১৪শ শতকে (১৩৪৬-১৩৫৩) এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশে যে মহামারি শুরু হয় তাতে ১০০ মিলিয়নের অধিক লোক মারা যায়। ইতিহাসে ‘ব্যাক ডেথ’ নামক পরিচিত এ মহামারি মূলত ইঁদুর হতে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা পাওয়া যায়। এ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে তৎকালীন ইতালির ভেনিস নগরী কর্তৃপক্ষ বন্দরে ভিড়তে থাকা যাত্রীদের ৪০ দিন পর্যন্ত তাদের নিজ জাহাজে অবস্থানের নির্দেশ দেন। ইতালীয় ভাষায় এই ৪০ সংখ্যাটিকে বলা হয় কোয়ারেনতিন যা থেকে আজকের দিনের বহুল প্রচারিত ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দটির উৎপত্তি। ৪০ দিন আবদ্ধ থেকে মহামারি আটকানোর এই পদ্ধতিটিকে ইতালীয় ভাষায় বলা হতো কোয়ারেন্তিনো।

দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ এই কোয়ারেন্টাইনের আশ্রয় নিয়েছে। সফলতাও পাওয়া গেছে এই পদ্ধতিতে। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল যখন এদের মধ্যে কয়েকজনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকল। আর তখন এই লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য উদ্ভাবন হলো আইসোলেশন পদ্ধতির। যেসব ব্যক্তিকে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হলেও সে সুস্থ হতে পারে আবার নাও পারে কিন্তু এ মুহূর্তে তার মধ্যে কোনো ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দেয়নি তাদের জন্য কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি আর যাদের রোগ ধরা পড়েছে কিংবা উপসর্গ দেখা দিয়েছে তাদের জন্য ব্যবস্থাকৃত পদ্ধতি হচ্ছে আইসোলেশন। সংক্ষেপে বলা যায়, আইসোলেশন হচ্ছে অসুস্থ’ ব্যক্তিদের জন্য আর কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে সুস্থ বা আপাত সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য।

যেকোনো রোগের জীবাণুর সুপ্তকালের ওপর নির্ভর করে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সুপ্তকাল ১৪ দিন তাই ব্যক্তির জন্য কোয়ারেন্টাইনও ১৪ দিন কারণ এই সময়ের মধ্যে তার উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আর এই ১৪ দিনের মধ্যে তার উপসর্গ দেখা দিলে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে এবং পুরোপুরি সেরে ওঠা না পর্যন্ত তাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। অর্থাৎ আইসোলেশনের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই এবং এ সময় রোগীকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে তাই ১৪ দিন হলেও আইসোলেশনে কিন্তু অনির্দিষ্ট সময় আটকে থাকতে হয়।

এভাবে চারদেয়ালে আটকে থাকা খুব সহজ নয়। হাউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট জন ভিনসেন্টের মতে, চারদেয়ালে আটকে থাকতে থাকতে আমাদের মস্তিষ্ক শুধু যে একঘেয়ে হয়ে উঠে তাই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে অসাড় হয়ে পড়ে কারণ সে এই সময় পৃথিবীকে সামান্য ইতিবাচক কিছুও দিতে পারছে না বলে।

সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়েও আমরা একঘরে হয়ে পড়ি। কতদিন এই পরিস্থিতিতে থাকতে হবে কেউ তা জানি না। আর এই প্রশ্ন থেকে তৈরি হয় দুশ্চিন্তা। লরেন্স পালিঙ্কাসের মতে, বিষণ্ণতা ও দুশ্চিন্তা হচ্ছে চুম্বনরত কাজিন। ফলে দুশ্চিন্তা থেকে একসময় ব্যক্তি বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোয়ারেন্টাইন ব্যক্তির মধ্যে উদ্বিগ্নতা বাড়ায় যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্নরকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটি তাদের সমীক্ষায় বলছে, করোনা আতঙ্কের জেরে এক ধাক্কায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। প্রত্যেক ৫ জন ভারতীয়র মধ্যে একজন এখন মানসিক রোগে ভুগছেন। সম্প্রতি কোয়ারেন্টাইনে থাকা ও না থাকা এই দুই শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচটি গবেষণার ফলাফল একত্রিত করে দেখা গেছে, কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ, বিরক্তি, রাগ, ঘুেমর সমস্যা, বিষণ্ণতা দেখা দেয় এমনকি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারও (পিটিএসডি) হতে পারে যা কোয়ারেন্টাইন পরবর্তী ১ মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। তাছাড়া নিজ বা পরিবারের স্বাস্থ্য নিয়ে ভয় বা উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, স্বাভাবিক দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তন এমনকি নেশাদ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাওয়া দেখা দিতে পারে।

শুধু রোগী বা ব্যক্তি নয়, কোয়ারেন্টাইনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝেও নানা ধরনের মানসিক সমস্যা লক্ষ করা যায়। সামজিক  ‍দূরত্ব কিংবা কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় ব্যক্তির মানসিক এসব সমস্যার পেছনে ব্যক্তির নিজের মধ্যে থাকা কিছু বিষয় ছাড়াও কোয়ারেন্টাইন বা সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কিত বিষয়গুলো দায়ী। যেমন: কোয়ারেন্টাইন বা সামজিক দূরত্ব কতটা দীর্ঘ তার ধারণা না থাকা, অপর্যাপ্ত তথ্য, প্রয়োজনীয় জিনিস বা দ্রব্যের অভাব, সামাজিক কিংবা পারিবারিক দূরত্ব, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়, আর্থিক চাপ কিংবা সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। এসব বিষয় কোয়ারেন্টাইনে থাকা রোগীর মানসিক রোগের কারণ। এ মানসিক চাপ বা ঝুঁকি, কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী এবং যাদের মানসিক রোগ রয়েছে বা নেই উভয়কেই সমানভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাছাড়া আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তির মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা গেলে যেমন-জ্বর বা কাশি হলে তা তার দুশ্চিন্তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। কারণ এখানে তার নিজের জন্য যেমন ভয় কাজ করে তেমনি তার কারণে পরিবারের অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছে কিনা তার জন্যও ভয় কাজ করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয় যা করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর দেখা গেছে।

চঞ্চলতা ও দুরন্তপনা শিশু কিংবা কিশোর বয়সের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। মাঠে-ঘাটে দৌঁড়ে বেড়ানো শিশু বা কিশোরদের হঠাৎ কোয়ারেন্টাইনে এনে আটকে ফেললে তাদের স্বাভাবিক চঞ্চলতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা। এর ফলে তাদের মধ্যে ভয়, খিটখিটে মেজাজ, বিষণ্ণতা, কর্মস্পহৃা কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং ঘুম আসতে বা মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। বয়স্কদের মধ্যে এর তীব্রতা বহুগুণ বেশি হয়। বিশেষ করে যারা আগে থেকে শারীরিক বা মানসিক রোগে ভুগছেন, সামাজিক বা পারিবারিকভাবে যারা বিচ্ছিন্ন এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে তাদের ক্ষেত্রে মানসিক রোগের তীব্রতা বেশি দেখা যায়। ভয় বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি এবং এক সময় দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা রোগ দেখা দেয় তাদের।

অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে কারো কারো মধ্যে নতুন করে বিভিন্নরকম শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে যেমন: মাথা ব্যথা, শরীরে বা পেটে ব্যথা অনুভব করা ইত্যাদি। বহু মানুষ এই গৃহবন্দি দশায় মানসিক সমস্যায় যেমন ভুগছেন তেমনি এই কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে অনেকদিন থাকাটা অনেকের জন্য এখনই বিপজ্জনক না হলেও ভবিষ্যতে মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই সময়টাকে বন্দিদশা না ভেবে কাজে লাগান। চেষ্টা করুন একে একটা উপভোগ্য ইতিবাচক সময়ে পরিণত করতে।

সূত্র:লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

 

Previous articleকরোনায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক গাইডবুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবাসাইটে
Next articleবিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here