করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলেছে

0
14

অর্থনীতিবিদ না হলেও অন্য সাধারণ মানুষদের মতোই আমার মনে হয়, করোনা মহামারি রোগের আক্রমণে কোভিড ১৯ রোগের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির কিছু নেতিবাচক দিক তৈরি হয়েছে। চলমান বিশ্বে এই করোনা ভাইরাসের মহামারির আক্রমণে কোভিড ১৯ রোগের অবশ্যই একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে তাতে। লকডাউনের মধ্যে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালতসহ সবকিছুই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। মানুষজন বাড়িতে বন্দী ছিলেন। এমনকি যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোতেও স্থবিরতা ছিল। আমরা তো জানি, যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরই বাংলাদেশসহ বিশ্ব নির্ভর করে। অনেক ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল থাকে। এটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই একটি দিকের মাধ্যমেই আমাদের সবার অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হোটেল, রেঁস্তোরা, মোটেলগুলোও করোনা ভাইরাসের আক্রমণে অনেকদিন বন্ধ ছিলো। ছোট, ছোট হোটেল, রেস্তোরাগুলোও একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেননা এই দীর্ঘ সময়ে অনেকদিন ধরে ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ইত্যাদি তাদের জন্য খুব কষ্টকর ছিল। মহামারি রোগের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দাটির পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাবও একটি গুরুত্বপূণ প্রভাবক হয়েছে। এছাড়াও কভিড ১৯ রোগের ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, টিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরা জানি, যারা সময় মতো টিকা দিতে পারছেন, তাদের অর্থনীতি এখন পুনরুত্থানে এক ধরণের কর্মযজ্ঞ দেখা যাচ্ছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সময় মতো টিকা দিতে না পারায় এক ধরণের অর্থনৈতিক নেতিবাচকতা ধারণ করে আছে। মহামারি রোগের জীবাণুর নতুন বিকল্প আসায় বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আমি মনে করি।

আমাদের কাছে তো নির্দিষ্ট কোনো তথ্য উপাত্ত নেই। সেগুলো ছাড়াই বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যদি বলি, করোনা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে এই দেশেও প্রচন্ড নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে; তবে ভুল হবে না। পাশাপাশি বলা প্রয়োজন- আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং দক্ষতায় অনেক দেশের চেয়ে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ওপর কম পড়েছে। পাশের দেশ ভারতেও কভিড ১৯ রোগ যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, আমাদের দেশে কিন্তু মোটেও সেভাবে এটি ছড়ায়নি, প্রভাব ফেলতে পারেননি। বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যে ও পরে সরকার খাদ্য এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে চলেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের কিছু সুবিধাও আমাদের পাওয়া হয়েছে। আগের অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ দমে কাজ করেছে। অনলাইনে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতেও দেখেছি। ডিজিটাল প্ল্যাটফম ঘিরে অর্থের চাকা ঘোরানোর চেষ্টা দেখেছি। অনেক ধরণের হোম ডেলিভারি-খাদ্য, পোশাক, মোবাইল ইত্যাদি ই-কমার্স সাইটগুলো, টেলিমেডিসিন সার্ভিস গড়ে উঠেছে। ঈদেও তারা কাজ করেছেন। কোরবানির ঈদের গরু কেনাবেচাও হয়েছে। খুব ট্যাক্টফুলি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে আমরা চেয়েছি; এখনো চেষ্টা করছি- কিভাবে অর্থনীতিকে সচল রাখা সম্ভব হয় ও পুনরুজ্জীবন ঘটানো যায়। এ বিষয়গুলো কাজে লাগানোর ফলে আমি বলবো, অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। এ আমার মনে হয়।

করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অথনৈতিক মন্দাতে কেবল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা নয়। বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিজেই তো আগে থেকে বড় ধরণের ঝুঁকিতে ছিল। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলেছে। আমরা জাতিগতভাবে যেমন, মানুষ হিসেবেও প্রত্যেকে সামাজিক জীব। কথা বলা থেকে শুরু করে একত্রে ওঠাবসা করার অভ্যাস আছে। বাঙালি কথা বলা জাতি- এটি সবাই জানেন। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে ফ্ল্যাটে বা বাসায় বন্দী থাকায় এই অভ্যাস কমেছে বলে ও কাজ থেমে যাওয়ায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন কম-বেশি সবাই। উদ্বেগ ও উত্তেজনা বেড়েছে। ফলে মোটের ওপর মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মহামারি রোগের কারণে যখন আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মানুষের কাজ থেমে গিয়েছে, বেতন কমেছে- মানসিক অস্থিরতা অনেক বেড়েছে। অনেক পরিবারে প্রধান ও পরিচালনকারীর খুব ভঙ্গুর দশা হয়েছে। অর্থনৈতিক দূরবস্থায় তারা আরো মানসিক দুর্দশায় পড়েছেন। আগে থেকেই বিষন্নতায় আক্রান্ত, উদ্বেগে ও উত্তেজনায় ভেঙে পড়া মানুষটি যখন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাতর, চাকরিজীবির চাকরি চলে যাচ্ছে বলে তিনি রাতে ঘুমাতেও পারছেন না; শিশু বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে যেতে পারছে না বলে মা টেনশনে ভুগছেন; বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের চাকরি চলে যাচ্ছে; ফলে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন- এই অবস্থাগুলো ঘটেছে। অনেকে খুব ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, তাদের পথে এসে প্রতিবাদে মুখর হতে হচ্ছে, পথের মানুষ হয়ে যেতে হচ্ছে; এই বিষয়গুলোতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে, এই সময়ে এবং পরিস্থিতিতে বিষন্নতা অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, মানসিক চাপও বহুগুণে বেড়েছে। এই অবস্থা এখনো বিদ্যমান। ফলে মানসিক অসুস্থতা সব বয়সের মানুষের মধ্যে বাড়ছে। মহামারি রোগের আক্রমণে নতুন করে মানসিক অসুস্থ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। আগে থেকে যারা মনের রোগে ভুগছিলেন, তারাও কষ্ট পেয়েছেন, পাচ্ছেন। আরো জানানো প্রয়োজন- অনেক মানসিক সেবা প্রতিষ্ঠান এই কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো। আমাদের পুরোনো অনেক রোগী তাদের সেবা নিতে পারেননি বলে মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে গিয়েছে। যারা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিলেন, অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাদের অনেকে কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেননি। ফলে তাদেরসহ মহামারি রোগে আক্রান্ত সবগুলো পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এসব তাদের জন্য বড় ধরণের হুমকি বাড়িয়েছে। প্রচুর মানুষকে আমরা দেখেছি ইন্টারনেটে প্যাকেজ কিনতে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। আরো বলবো, কিশোর-তরুণদের অনেকের মধ্যে হতাশার ফলে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে, নতুন করে আসক্ত হয়েছেন অনেক। সেটি আমাদের ভবিষ্যতের অর্থনীতিকে ভেঙে দিচ্ছে।

এই বিষয়গুলোতে সতর্কতা ও সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজ অনেকদিন ধরে করা হচ্ছে। মানুষকে সাহায্য করতে হবে। আর যেকোনো সতর্কতামূলক অবস্থার জন্য মাথায় রাখতে হবে- সবার জন্যই প্রযোজ্য এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায় কী, এটি সামগ্রিকতার সঙ্গে জড়িত। যেমন সবার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের আক্রমণে পড়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণে সেটি বেড়েছে। আমাদের এমন কাজ করতে হবে, যাতে প্রথমেই সবার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এজন্য মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের কুসংস্কার, সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো দূর করতে কাজ করতে হবে। তাহলে মানুষের মানসিক অসুস্থতায় চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বাড়বে। কারো মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে- তাহলে তিনি একজন পেশাদার চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। এই সাহায্য নেবার স্থানটি যেন এ দেশে উন্মুক্ত রাখা সম্ভব হয়। যোগ্য মানসিক পেশাদার সৃষ্টি করতে হবে। এই কাজগুলো আমাদের সবাইকে করতে হবে। ঢাকাসহ সারাদেশে যেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় সেটি তৈরি করতে হবে। যারা আগে থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধাদিসহ অন্যান্য সেবা দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই- এমন রোগীদের জন্য আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য ও বিনামূল্যে করতে হবে। এই ব্যবস্থা দেশে করতে হবে। আমরা সবাই শারীরিক বিভিন্ন অনুশীলন- ব্যায়াম, ব্যায়ামাগারে যাই, শরীরকে ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে; কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য আমরা যেসব অনুশীলন করতে পারি, করা যায়; সেগুলো আরো ভালোভাবে, মনোযোগ দিয়ে জানাতে হবে, অনুপ্রাণিত করতে হবে। পরিবারগুলোর মধ্যে পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। শিশুরা যেন অনমনীয় না থাকে সে বিষয়গুলো বাবা-মাকে জানাতে হবে, সতর্ক করতে হবে। মাদকের দিকে যেন কিশোর যুব সমাজ না যান, সেজন্য তাদের উদ্দীপ্ত করতে হবে। মাদকের খারাপ দিকগুলো বারবার জানাতে হবে। এমন অসুস্থতায় ভুগলে দেরি না করে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কখনো কথা বলি না, তাদের এই বিষয়টিকে আমাদের কাজের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কভিড ১৯ রোগের মধ্যে তাদের উদ্বেগ ও অশান্তি বাড়ছে কী না, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তাদের জন্য সতর্ক ও যত্নবান হতে হবে। যারা আগে থেকে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, তারা ঠিক মতো ওষুধ খান না। সেগুলো খাওয়া ও প্রয়োজনে যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাখাতকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। এই খাতে আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন। অবহেলা না করে মানসিক রোগী এবং রোগের মতো এই খাতের প্রতিটি স্তরে যেন আমরা বিনিয়োগ করি এবং করতে এগিয়ে আসি। তাহলে সুফল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র অবশ্যই পাব। একজন মানুষ যখন মানসিক রোগে ঘরে বসে থাকেন, তখন তিনি পরিবারেরও বোঝা হয়ে যান। যখন তিনি কাজ করতে পারবেন এবং যাবেন তখন তিনি পরিবারে জন্য সম্পদ হবেন। সার্বিক অর্থনৈতিক কারণেও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নজর এবং নজরদারি করতে হবে।

 

ডা. তানজীর রশীদ স্বরণ

এমবিবিএস, এমপিএইচ, এমডি (সাইকিয়াট্রি), এমএসসি গ্লোবাল (ই-হেলথ)

প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক

টেলিসাইকিয়াট্রি রিসাচ অ্যান্ড ইনোভেশন নেটওয়াক লিমিটেড।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

 

Previous articleপ্যানিক ডিসঅর্ডারে কার কি দায়িত্ব
Next articleবুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তাশীল মানুষ হতে হলে মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here