করোনাঃ ভয়-আতঙ্ক মোকাবেলা

করোনাঃ ভয়-আতঙ্ক মোকাবেলা
করোনাঃ ভয়-আতঙ্ক মোকাবেলা

সুমনা ভাবি এসেছিলেন। খুব চিন্তিত,প্রায় উদ্ভ্রান্তের মত অবস্থা। কয়েকদিন যাবৎ নাকি ঘুম হচ্ছে না, বুক ধড়ফড় করে সবসময়। আমার কাছে এসেছেন ঘুমের ওষুধ লিখে নেয়ার জন্য।
বললাম,ভাবি করোনা সংক্রমণ নিয়ে কি খুব ভয় পাচ্ছেন? ভাবিকে কাছে বসিয়ে কথা বললাম অনেক্ষন।
ওনার দুইটা স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা,স্বামী সরকারি চাকুরিজীবি,ঘরে আছেন শ্বাশুড়ি। ওদিকে বাবা মা থাকেন অন্য শহরে। করোনা মহামারীর এই সময়ে সব মিলিয়ে সবার চিন্তায় উনি পাগল প্রায়। এত স্ট্রেস নিতে পারছেন না।
আসলে সুমনা ভাবির মত অবস্থা আমাদের প্রায় সবার। সবসময় একটা অজানা ভয়ের মধ্যে কাটছে সময়।
এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢু মারার অভ্যাস তো আছেই। সেখানে সত্যের পাশাপাশি জাল সংবাদ,বা গুজবের ও ছড়াছড়ি।সারাজীবন ধরে চলা যে অভ্যাস, তার ব্যাত্যয় ঘটায় অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না,কিভাবে সামাল দিবেন এই মহামারী অবস্থাকে।ফলে মানুষ ভয়,আতঙ্ক, উদ্বেগ,বিরক্তি,রাগ বা হতাশায় ভুগছেন।
চীনে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল COVID-19 এর প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবের সময়। এই গবেষণায় পাওয়া গেছে উত্তরদাতাদের মাঝে ৫৩.৮% এর মানসিক রোগের (মাঝারি বা গুরুতর) প্রাদুর্ভাবের; এর মধ্যে ১৬.৫% মাঝারি থেকে গুরুতর হতাশার লক্ষণ; ২৮.৮%  মাঝারি থেকে গুরুতর উদ্বেগের লক্ষণ এবং ৮.১% এর মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপ। যেকোনো মহামারী,দূর্যোগে প্রচন্ড মানসিক চাপ,ভয় থেকে মানসিক রোগের লক্ষন থাকাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তাই ভয় নয়।জানতে হবে করোনা ভাইরাসকে (COVID-19),আর জয় করতে হবে ভয়।প্রথমেই যদি জানি এই যে অজানা ভয় করোনা ভাইরাস নিয়ে,সেটা কেন?
প্রথমত বলতে গেলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ছড়িয়েছে করোনা,উন্নত দেশগুলো ও কন্ট্রোল করতে পারছেনা এর বিস্তার থামাতে।ভয়টা সেখানেই।ওরা পারছে না,আমরা কিভাবে পারবো?
দ্বিতীয়ত,কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই এর আক্রান্তদের। ফলে যদি কেউ আক্রান্ত হয়,কি হবে এটা নিয়ে টেনশন। তাছাড়া পর্যাপ্ত টেস্টিং কীটের সমস্যা থাকায় রোগ ডায়াগনোসিস নিয়েও কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা হচ্ছে।
এছাড়া দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা ,আর কিছু নতুন শব্দ (অনেকের জন্য) যেমন লক ডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন,এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রিয়জনদের নিয়ে টেনশন ইত্যাদি সব কিছু একটা ভীতির জন্ম দিয়েছে।
এখন যদি দেখি,কি হচ্ছে মানুষের মধ্যে? প্রথমেই যে শব্দটা আসে,সেটা “করোনা আতঙ্ক”। বলা হচ্ছে আতঙ্কিত,ভীত হবেন না। মানুষের মধ্যে সেই আতঙ্ক বা ভীতি, বা হতাশা কিভাবে প্রকাশ পাচ্ছে,সেটা জেনে নেয়া যাকঃ
১.সহজেই বিরক্ত বা রাগ হওয়া।
২.ঘুম কম হওয়া,বা না হওয়া।
৩.অস্থিরতা, বুক ধড়ফর করা।
৪.ভয় লাগা।
৫.সবকিছুতে মনোযোগ বা আগ্রহ কমে যাওয়া।
৬.হতাশ লাগা,বিষন্ন লাগা ইত্যাদি।
তাহলে প্রশ্ন আসে,কি করণীয় আমাদের?? শুধু কি হাত ধোয়া,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাই সারাদিন করে যেতে হবে!
না,তা নয়।
মনকে শান্ত রাখুন,এটাই প্রথম কাজ।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ  ডাক্তাররা ও এই করোনা পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ মোকাবেলায় কিছু করণীয় বলে দিয়েছেন।সেগুলো কি প্রথমে জানিঃ
➤এসময়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ বোধ হওয়া স্বাভাবিক।তাই শেয়ার করুন নিজের মনের কথাগুলো আপনজনের সাথে বা যাকে বিশ্বাস করেন, তার সাথে।
নিয়মিত খোঁজ খবর নিন আত্মীয় পরিজনদের। এতে মন ভালো থাকবে।
➤নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান।
➤বাসায় ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে পারেন।করতে পারেন রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ। যেমনঃব্রিদিং টেকনিক,মেডিটেশন, ইয়োগা, মাইন্ডফুলনেস ইত্যাদি।
➤আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেন,প্রার্থনা করতে পারেন।প্রার্থনা মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে।
➤দুশ্চিন্তা কমান,যদি মনে করেন বারবার টিভি,বা ফেইসবুক, টুইটারে করোনার সংবাদ আপনার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছে….কমিয়ে ফেলুন ঢু মারা ফেইসবুক,টিভিতে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় গুজব,অতিরঞ্জিত খবর ঘোরাফেরা করে,তাই সঠিক সংবাদ নেয়ার চেস্টা করুন।যেমন,বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েব সাইট,বাংলাদেশের IEDCER এর সাইট,বা এমন নির্ভরযোগ্য জায়গা থেকে সঠিক তথ্য গ্রহণ করুন।
মানসিক চাপ অত্যাধিক মনে হলে সাইকিয়াট্রিস্ট এর পরামর্শ নিন।আগে থেকে ডিপ্রেশন, এংজাইটি বা মানসিক সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিয়ে থাকলে সেটা নিয়মিত কন্টিনিউ করেন।
➤নেশাদ্রব্য গ্রহন থেকে বিরত থাকুন।
➤নিজের পছন্দের কাজ করুন,হয়তো অনেকদিন সেটা করা হয় না।সেটা হয়তোবা ছবি আঁকা,গান করা,দারুন কিছু রান্না বান্না ইত্যাদি।
আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট যেটা,সেটা হচ্ছে- “think positively “।ভাবুন তো,ঠিক কতদিন কিংবা কতবছর পর পরিবারের সবাই মিলে একসাথে সময় কাটাচ্ছেন? ঈদের সময় হয়তো কয়েকদিন ছুটি পাওয়া হয়,কিন্তু সেটা চলে যায় শপিংয়ে, ঘুরতে আর অতিথি আপ্যায়নে।নিজেদের জন্য সময় কোথায়?
এখন এইযে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান,বাবা-মা সবাই একসাথে আছেন,এই ব্যাপারটা এনজয় করুন।অন্যান্য সময় অফিস,স্কুল কলেজ আর বাচ্চাদের পেছনে দৌড়ানোর পর আর এনার্জি থাকে না একসাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর।এখন এই সুযোগে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারেন।
ঘরের কাজ সবাই মিলে ভাগ করে নিন।এতে একজনের উপর চাপ পড়বে না।সবার দ্বায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে।বাচ্চাদের কিছু কাজ শেখাতে পারেন,সেটা সিম্পল রান্না হতে পারে,বা অন্য কিছু।
পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্প করুন,সেটা হতে পারে সেটা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে আগেকার দিনের গল্প শোনা বা নিজেদের কোনো মজার এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার। ক্যারাম,লুডু জাতীয় খেলা খেলেতে পারেন,রাখতে পারেন মুভি নাইটের ব্যবস্থা।খাবারের সময় একসাথে টেবিলে বসুন।
আর হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক গুজব,উল্টাপাল্টা সংবাদের ভীড়ে মাঝে মাঝে কোনো কোনো খবর দারুণ মন ভালো করে দেয় এই দুঃসময়েও।করোনা সংক্রমণের খবরের প্রথম দিকে যখন বাজারে হ্যান্ড সেনিটাইজার,মাস্ক পাওয়া যাচ্ছিলো না,দেখা গেল অনেক ভার্সিটির ফার্মেসী ডিপার্টমেন্ট,এবং অনেক প্রতিষ্ঠান স্ব-উদ্যোগে হ্যান্ড সেনিটাইজার বানাচ্ছে,অনেকেই মাস্ক বানিয়ে বিতরণ করছে।
ডাক্তাররা যখন আনপ্রটেক্টেড অবস্থায় চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিলো,মানুষের সহমর্মিতা ছিলো চোখে পড়ার মত।অনেক প্রতিষ্ঠান ডাক্তারদের PPE ‘র ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।
নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এ কঠিন সময়ে অনেকেই এগিয়ে আসছে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে…..যদি সামর্থ্য থাকে আপনিও চেস্টা করুন তাদের জন্য কিছু করতে।দেখবেন মনটা অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে গেছে।
এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবরে ১৯৯ টি দেশে করোনা সংক্রমণ হয়েছে।করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে আপনি একা নন।এই যুদ্ধ জীবানুর বিরুদ্ধে সমগ্র মানব জাতির।আমরা অবশ্যই জয়ী হব সবসময়ের মতই।তাই মনে সাহস রাখুন।ভালো থাকুন।
আর হ্যাঁ, প্রতিনিয়তই হাত ধোয়া,পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহ হলে মাস্ক পরুন,কোয়ারেন্টাইনে থাকুন,সরকারের দেয়া হটলাইনে ফোন করে ডাক্তারের পরামর্শ মত চলুন।
#STAY_HOME_STAY_SAFE
#KEEP_SOCIAL_DISTANCE
 
 
 
 
 
 

Previous articleকরোনাভাইরাস: সামাজিক দূরত্ব কিভাবে বজায় রাখবেন?
Next articleকরোনাভাইরাসে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ বেড়েছে:গবেষণা
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here