মানুষের কথোপকথন বা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার গোপন রহস্য আসলে কী – তা কখনোই মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়নি। কথোপকথনকে আরও ধারালো ও উন্নত করতে পারলে সবদিকেই সফল হওয়া যায়।
ব্রিটিশ লেখক মাইকেল রোজেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মান উন্নয়ন থেকে শুরু করে কীভাবে কথোপকথনকে আরও ভাল করে তোলা যায় সেটা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন।
নিজ বাড়ি থেকে শুরু করে অফিসের বোর্ডরুম কিংবা বৈশ্বিক পরিসরে যেকোনো ধরণের সমস্যার সমাধান বা দ্বন্দ্বের অবসানে একটি কার্যকর কথোপকথনের কোন বিকল্প নেই।
সম্প্রতি প্রকাশিত `দ্য টকিং রেভোলিউশন` বইটির লেখক এডি কানফোর-দুমা এবং পিটার অসবর্নের সাথে রোজেন মিলে – কথোপকথন কীভাবে ভাল করে তুলতে হয় তার সাতটি উপায় বের করেছেন।
১. আগে নিজে বোঝার চেষ্টা করুন:
আমাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিনিয়ত `ট্রান্সমিট মোড` বা কথা বলার মোডে থাকে। এবং তাদের পক্ষে সেই মোড পরিবর্তন করে `রিসিভিং মোড` অর্থাৎ অন্যের কথা শোনার মোডে যাওয়াটা অনেক কঠিন মনে হয়।
এই পরিবর্তন করতে না পারাই ব্যক্তিগত এবং পেশাদার সম্পর্কগুলোয় সমস্যা তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ। বইটিতে, বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাতটি অভ্যাসের কথা তুলে ধরা হয়।
আর এ ব্যাপারে স্টিফেন কোভি বলেছেন, অন্য কেউ আপনাকে বুঝবে এটা আশা করার আগে আপনি অন্যকে বোঝার চেষ্টার করুন। আর এ জন্য অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা এবং নিজের মতামত দেয়ার আগে বা চ্যালেঞ্জ করার আগে তারা কী বলছে সেটা পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করা বেশ জরুরি।
২. আপনি যে বুঝতে পেরেছেন সেটা প্রকাশ করুন:
যদি আপনি অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারেন, তাহলে সেটা প্রকাশ করুন। আপনি কি শুনেছেন বা বুঝেছেন সেটা তাকে বলুন।
কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়া দিতে পারেন, যেমন “ঠিক বলেছেন” বা “আমি আপনার জায়গায় হলে এতো ভাল থাকতে পারতেন না।” -এই কথাগুলো এটাই ব্যাখ্যা করে যে আপনি এই কথোপকথনের তরঙ্গে ভাসছেন।
যখন অপর ব্যক্তি বুঝতে পারে যে আপনি তাকে বুঝতে পারছেন, তখনই আপনি তাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারেন, অথবা তার কোন বক্তব্য বা ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।
তবে সেটা অবশ্যই তখন করবেন, যখন আপনি তার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাবেন।
আপনি যে ব্যক্তির সাথে কথা বলছেন তার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা বেশ জরুরি – সেটা তার কথা শোনার মাধ্যমে, তার প্রয়োজনকে শ্রদ্ধা করার মাধ্যমে বা সেটাকে বোঝার মাধ্যমে হতে পারে।
এভাবে আপনি একটি সংযোগ তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রকৃত যোগাযোগ প্রবাহিত হতে পারে।
৩. সৃজনশীল সমাধানে পৌঁছাতে সহযোগিতা করা:
এডি এবং পিটার `সৃজনশীল কথোপকথন` নামে একটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন যেটা কিনা একজনের ব্যাপারে আরেকজনের মধ্যে নতুন চিন্তাভাবনা এবং বোঝাপড়া তৈরি করতে সাহায্য করে।
এজন্য অন্য মানুষের কথার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেয়া এবং আপনি তাকে কতোটুকু বুঝতে পেরেছেন সেটা প্রতিক্রিয়া দিয়ে জানানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
এটি মানুষের মধ্যে কখনও কখনও নতুন অন্তর্দৃষ্টি জাগিয়ে তোলে যেটা কিনা আলাদাভাবে হয় না।
এছাড়াও, আপনি যদি আপনার বোঝাপড়ার বিষয়টি প্রকাশ করেন, তাহলে সেটি অপর ব্যক্তিকে আরও খোলামেলা হতে, ভাগ করে নিতে, আরও বেশি নিরাপদ ও স্বাধীন বোধ করতে সাহায্য করে।
যা তাদের নিজেদের চিন্তাধারাগুলোকে অন্বেষণ করতে সহায়তা করে।
এছাড়া আপনার মধ্যেও এমন নতুন কিছু তৈরি করা সম্ভব যা আগে বিদ্যমান ছিল না এবং যেটা আপনাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেও সাহায্য করবে।
৪. অভ্যাসে বিরতি নিন:
আমরা আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকেই নিজেদের কথোপকথনের অভ্যাস পেয়েছি। অনেক সময় আমরা নিজেদের সেই কথোপকথনের ব্যাপারে সচেতন থাকিনা।
অনেক সময় আমরা অন্যের কথার মাঝখানে কথা বলতে শুরু করি বা অপ্রাসঙ্গিক অন্য কোন আলাপের দিকে চলে যাই।
এতে কোন কথারই কোন মানে থাকেনা। এবং কথোপকথন তার রেশ হারায়। চেষ্টা করুন কখন এই সমস্যাটি হয়, এটার কোন প্যাটার্ন থাকলে সেটা বের করার।
এই অভ্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের কথা শোনার এবং তা বোঝার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
৫. সমালোচনার জন্য শুনবেন না:
কিছু লোক শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্যেই অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে আর তা হল অন্যের সমালোচনা করতে এবং বিরোধী পক্ষকে পাল্টা তীরের ছুঁড়ে ঘায়েল করতে।
রাজনীতির জগতে আমরা প্রতিদিন এমন কিছু দেখি, যেখানে মানুষ বিভিন্ন দল গঠন করে এবং এই বিভাজন নিয়ে কথা চালিয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে, আপনার কথা শোনার কারণ যেন অন্যকে ঘায়েল করা না হয় – এজন্য একটি যুক্তির দুটি দিক সম্পর্কেই ভালভাবে শুনে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অনুশীলন নিখুঁত করে তোলে:
এডি এবং পিটার দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি অনুশীলনের আয়োজন করে যেখানে ওই দুই ব্যক্তির সেটাই প্রথম দেখা।
অনুশীলনের সময় দুইজনকে দুটি ভিন্ন দায়িত্ব দেয়া হয়। একজনকে বলা হয় নিজের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে, এবং অপরজনকে বলা হয় সেই কথা শুনে বুঝতে।
এর মাধ্যমে তাদের এমন একটি বিষয় খুঁজে বের করতে বলা হয় যার ব্যাপারে দুজনই ভিন্নমত পোষণ করে।
এটি সেই ব্যক্তিদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কারও কান ধার পাওয়াটা কতো বিরল এবং আশ্চর্যজনক একটি উপহার।
এই দক্ষতাটি বন্ধুদের সাথে অনুশীলনের চেষ্টা করতে পারেন যাতে আপনি যখন সত্যি সত্যি কোন দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধের মুখে পড়বেন, তখন সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে উৎরে যেতে পারেন।
৭. যোগাযোগের জন্য আপনি কোন মাধ্যমটি চান সেটা বেছে নিন:
মুখোমুখি যোগাযোগকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। এরপর আপনি যতোই সেখান থেকে সরে আসবেন, আপনার যোগাযোগের মাধ্যমটি ততোই সংকীর্ণ হতে থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ টেলিফোনে, আপনার শারীরিক কোন উপস্থিতি নেই – সেখানে আপনার কণ্ঠ দিয়েই সব কাজ করতে হবে।
আবার যখন আপনি কাউকে ক্ষুদে-বার্তা পাঠান সেখানে কোন শব্দও থাকেনা, থাকে শুধু লিখিত কথা।
এবং যদি আপনি টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলিতে নাম পরিচয় গোপন করে কিছু পোস্ট করেন, সেখানে যোগাযোগের মাধ্যমটি আরও সংকীর্ণ থাকে।
কেননা সেখানে ব্যক্তির পরিচয় ছদ্মনাম দ্বারা লুকানো থাকায় তার কথোপকথন অপমানজনক এবং অবমাননাকর হতে পারে।
তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি মাধ্যমের ক্ষমতা বুঝতে পারাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কার্যকর কথোপকথনের জন্য যখন যেখানে সম্ভব মুখোমুখি যোগাযোগের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা