মিতু (ছদ্দনাম) এসেছে গ্রাম থেকে। বাড়ীতে তার অসুস্থ মা, স্কুলে পড়া ছোট ভাই আর বৃদ্ধ বাবা। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে সে। মেসে থাকে। নিজের খরচ আর তা বাঁচিয়ে কিছু টাকা বাড়ীতে পাঠাতে পারলে তার ভালো হয়। একদিন কলেজের দেয়ালে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে পড়ানোর জন্য মহিলা শিক্ষক চাই, সাথে যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বর দেয়া। বেতন পাঁচ হাজার টাকা। টাকাটা মিতুর প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা বেশী হওয়াতে সে আগ্রহী হয়ে উঠে। সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায় এই ভয়ে সে সাথে সাথেই ফোন করে। ফোনের ওপাশ থেকে তাকে একটি বাসার ঠিকানা দেয়া হয়। ঠিকানা মতো গিয়ে দেখে সে এক ফাঁদে পা দিয়েছে। কিন্তু তখন তার আর করার কিছু থাকে না। সেখানে ধর্ষিত হয় সে এবং তার ধর্ষণ দৃশ্য ভিডিওতে তুলে রাখে তারা। ঢাকায় মিতুর আপন কেউ নেই। মেসের রুমমেটরাও যে যার মত ব্যস্ত। সহপাঠীদের সাথেও সে ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। ধীরে ধীরে সে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। মিতু দেখে যা তার জীবনে ঘটে গেছে তা আর মুছে ফেলার উপায় নেই। কি করবে সে? কোথায় যাবে? কাকে বলবে? কে বুঝবে তাকে? মাস গেলে খরচের টাকাই বা সে কোথায় পাবে? যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসেছে তা আর কোনদিনও পূরণ হওয়ার নয়। যখন রুমমেটরা বাইরে যে যার মতো কাজে তখন সে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি সত্যি, কোন বানানো গল্প নয়।
মিতু হয়তো আত্মহত্যা করতো না যদি সে সঙ্গী পেতো। কাউকে বলতে পারলে তার কষ্টটা হয়তো অনেকটাই লাঘব হতো। যে যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো, যা সে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো তা যে নিছক একটি দুর্ঘটনা। তার থেকে জীবন যে অনেক বড় সে কথাটা তাকে মনে করিয়ে দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। গ্রামে রেখে আসা তার পরিবার ছাড়া বিশাল ঢাকায় সে ছিলো গুরুত্বহীন একা। কারো কাছে একটু যত্ন পেলে, একটু গুরুত্ব পেলে হয়তো পুরো দৃশ্যপটটাই বদলে যেতো।
এটা শুধু মিতুর কথা নয়, প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনের গল্পটা অনেকটা এরকম। হতাশা আর বিচ্ছিন্নতা। ঘটনা যে রকমই ঘটুক তা যখন একজন মানুষকে হতাশ করে, ক্রমশ হতাশায় নিমজ্জিত করতে থাকে, বেঁচে থাকাটা তার কাছে যখন অর্থহীন মনে হয় তখন সে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে তার চারপাশের মানুষদের থেকে। আর তাই এই বিচ্ছিন্নতার উপর গুরুত্ব দিয়েই এ বছর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় করা হয়েছে, “সেবার হাত বাড়িয়ে দাও এবং জীবন বাঁচাও”। বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে। এ উপলক্ষে অনলাইন পোর্টাল মনেরখবর.কম এক সপ্তাহব্যাপী আত্মহত্যা বিষয়ক বিভিন্ন লেখা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো সেবার হাত কোথায় বাড়াবো এবং কিভাবে বাড়াবো। যার আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকে খোঁজা যেতে পারে। উদ্যোগী হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। কথা শুনতে হবে। তাকে বুঝতে এবং বোঝাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে আমরা তার প্রতি যত্নশীল এবং আমাদের কাছে তার বেঁচে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাকে বিচ্ছিন্ন থাকতে দেয়া যাবে না। তাকে যুক্ত করতে হবে সমাজের সাথে।
যে আত্মহত্যা করে সে যাদেরকে রেখে যায় অর্থাৎ যারা সুইসাইড সার্ভাইবর তাদের কাছেও যেতে হবে। বাড়াতে হবে সেবার হাত তাদের প্রতি। তাদের মধ্যেও দুঃখ আছে, রাগ আছে, আছে ক্ষোভ, অপরাধবোধ এবং অবিশ্বাস। তারাও তাদের দুঃখের কথা কষ্টের কথা কারো সামনে মেলে ধরতে পারে না। কারণ অন্য মৃত্যুর থেকে এ মৃত্যু আলাদা। অনেক সময় লোকজন তাদের এড়িয়ে চলে কারণ তারা বুঝতে পারে না এ মৃত্যু নিয়ে তারা কিভাবে কথা বলবে, কি বলে সান্তনা দিবে। ফলে সার্ভাইবরদের ধারণা হয় অন্যরা তাদের কষ্টের মাত্রাটা বুঝছে না। তাই তাদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। প্রতি বছর প্রায় আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে। আর এই আট লাখ মানুষের সাথে আট লাখ পরিবারকেও এ কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের কাছে যাওয়া, তাদের কথা শোনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কষ্টের কথা বলতে পেরে তারা হালকা হবে এটাই সেবা।
যদিও আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তবুও আনুষ্ঠানিক বা ফরমাল সহযোগীতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নত বিশ্বে এই সেবাটা প্রফেশনালদের মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে। আমাদের মতো স্বল্প বা মধ্যম আয়ের দেশে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ ধরনের সেবা দেয়। সেবার হাত বাড়ানোর মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে সুইসাইড সার্ভাইবরদের সাথে ঐসব সামাজিক সংগঠনের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়া।
সারা বিশ্ব জুড়ে এমন অনেকগুলো সহায়তাকারী সামাজিক সংগঠন আছে। সংগঠনগুলোরও পরষ্পরের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। তাদের পারষ্পরিক সংযোগ জ্ঞানের প্রমাণ সাপেক্ষে কার্যকরী প্রয়োগকে শক্তিশালী করবে। সহায়তাকারী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়ে আনবে বলে সচেতন মহল ধারণা করেন।
১০ সেপ্টেম্বর সবার সাথে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে সংগঠনগুলো যার যার সামাজিক অবস্থান থেকে যুক্ত হতে পারে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংঘের সাথে। সবাই মিলে গড়ে উঠতে পারে একটি চক্র সারা বিশ্ব ব্যাপী।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।