আই কিউ, বুদ্ধির হিসাব-নিকাশ

0
13
ভুলে যাওয়া অপকার ও উপকার

অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ
অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

দীপ্ত এত বোকা অথচ তারই ছোট ভাই সুপ্ত এত বুদ্ধিমান। দ্বীপ্ত কোনো কিছুই ঠিকমতো করতে পারে না, বছর বছর পরীক্ষাতে ফেল করে, কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না, অথচ বয়স এখন ১৫ বছর। সে অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা কিন্তু পড়ে ক্লাস সেভেনে। ওকে দিয়ে কিছু হবে না, মানুষের কাছে লজ্জায় মাথা কাটা যায় মা-বাবার। সুপ্ত তার চেয়ে তিন বছরের ছোট অথচ সে সবকিছু ঠিকমতো করে, ক্লাসে খুব ভালো ফল করে, খেলাধুলাতেও পারদর্শী।

খেয়াল করলে আমরা দেখতে পারি, আমরা সারাক্ষণ নিজেদের এ ধরনের তুলনা দিতে থাকি বা সম্মুখীন হই। ও এটা পারে, সেটা পারে, সে কত বুদ্ধিমান। আসলে বুদ্ধি ছাড়া চলা যায় না। বুদ্ধিই মানুষের চালনাশক্তি। প্রকৃতি, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনের সবরকম কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, সব সমস্যার সমাধান করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বুদ্ধি আমাদের বড় হাতিয়ার। তবে কি সবার বুদ্ধি থাকে না?
না, তা নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, একজন মানুষের মগজের মোট ওজনের ৮০ ভাগই তৈরি হয় জীবনের তিন বছরে, প্রতিটি মানুষই নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মায়, তবে কারো বেশি, কারো কম বা স্বাভাবিক। তবে বুদ্ধি কী?

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন বুদ্ধির সংজ্ঞা দিয়েছেন- মনোবিজ্ঞানী ক্যাটেল বলেন- Intelligence is what intelligence does, অর্থাৎ বুদ্ধি যে কাজ করে তার মধ্যেই বুদ্ধির পরিচয়। ডিয়ারবার্ন বলেন- বুদ্ধি হলো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার ক্ষমতা। স্টার্ন বলেন- বুদ্ধি হলো নতুন সমস্যা ও অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের সাধারণ মানসিক শক্তি। মানুষ দু’ভাবে বুদ্ধি লাভ করে থাকে। সহজাত এবং শিক্ষার মাধ্যমে। সহজাত বুদ্ধি হলো- যে বুদ্ধি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। আর শিক্ষণীয় বুদ্ধি হলো, যা শেখার মাধ্যমে বাড়ানো যায়।

মেধা বা বুদ্ধিমত্তার পরিমাণ মূলত জন্মগতভাবে নির্ধারিত। এছাড়া শিশুকাল পরিবেশ-পরিস্থিতিও কিছু অংশে প্রভাব ফেলে। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, আমরা আমাদের বাবা ও মা দু’জনের বুদ্ধিমত্তার কিছু অংশ করে পেয়ে থাকি। তাই যাদের বুদ্ধিমত্তা অন্যদের থেকে বেশি, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তাদের বাবা ও মায়েরও বুদ্ধিমত্তা অন্য মানুষদের বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি। একটি বৈজ্ঞানিক রিসার্চের মাধ্যমে জানা যায়, আপনার জীবনসঙ্গী যদি বুদ্ধিমান হয়, তাহলে যে বাচ্চার জন্ম দেবেন তার বুদ্ধিমত্তা, জীবনসঙ্গী কম বুদ্ধিমান হলে যে বাচ্চার জন্ম দেবেন তার বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অনেক বেশি হবে।মানুষের বুদ্ধিমত্তা মোটামুটি যৌবনে পদার্পণের পর আর বৃদ্ধি পায় না। তবে এক্সপেরিয়েন্স বৃদ্ধি পায় বলে আমাদের কাছে মনে হয় যতই বয়স হয় ততই বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায়। আবার কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোও যেতে পারে। তবে তা খুবই স্বল্প পরিমাণে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই আলাদা বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মেছেন। তবে যার যতটুকু বুদ্ধিমত্তাই আছে, তার সম্পূর্ণ ব্যবহার করেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্রসহ সবখানে সফল হতে পারেন। বুদ্ধিমত্তা একজনের চেয়ে আরেকজনের কম না বেশি তা জানার জন্য অবশ্যই পরিমাপ করতে হবে। পরিমাপ করে তুলনা করলেই আমরা সেটা পেয়ে যাব। বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের এই পদ্ধতি হলো আই কিউ টেস্ট (IQ Test) I.Q-এর পূর্ণরূপ Intelligence Quotient যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘বুদ্ধ্যাঙ্ক বা বুদ্ধির পরিমাপ, বিশ্বব্যাপী এর প্রচলন রয়েছে।

আই কিউ (I.Q)-এর গাণিতিক সংজ্ঞা হচ্ছে- বুদ্ধ্যাঙ্ক I.Q) = (মানসিক বয়স/স্বাভাবিক বয়স) ১০০ ( সাধারণত ১৬ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরা যেসব সমস্যার সমাধান করে থাকে আর সেসব সমস্যার সমাধান যদি ১২ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরা করতে সক্ষম হয়, তাহলে তার মানসিক বয়স ধরা হবে ১৬।

সুতরাং তার আই কিউ (I.Q) ধরা হবে (১০/৭) ১০০ বা ১৪২। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে শতকরা ৪৬ জনের আই কিউ (I.Q) ৯০ থেকে ১১০-এর মধ্যে আর শতকরা ৩ জনের আই কিউ (I.Q) ১৩০ বা তার চেয়ে বেশি।

ঠিক তেমনই আবার সাধারণ মানুষের শতকরা ৩ জনের আই কিউ (I.Q) ৭০ বা তারও কম। বর্তমান যুগে বুদ্ধি মাপার জন্য যে অসংখ্য টেস্ট বা অভীক্ষা উদ্ভাবিত হয়েছে, তাতে মূলত বিভিন্ন ধরনের অঙ্ক, কুইজ এবং ধাঁধা দেওয়া হয়ে থাকে। আর এই সমস্যা সমাধান করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতগুলো প্রশ্নের নির্ভুল সমাধান বের করছে তার ওপর নির্ভর করে তার মানসিক বয়স এবং বুদ্ধ্যাঙ্ক আই কিউ (I.Q) নির্ণয়।

আই কিউ (I.Q) স্কোরিং আই কিউ (I.Q) স্কোর যদি হয় (16 deviation) ৭০-এর নিচে তাহলে বলা যায় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। বুদ্ধিমত্তা আশ্চর্যজনকভাবে কম। পৃথিবীতে মাত্র ২.১% মানুষের আই কিউ (IQ)। ৭০-৮৪ তাহলে বলা যায় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার বর্ডার লাইনে দাঁড়িয়ে, বুদ্ধিমত্তা খুবই কম রয়েছে ১৪% মানুষের আই কিউ (I.Q)। ৮৫-১২৯ – বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক। খুব বেশি না আবার খুব কমও না।

মধ্যম শ্রেণির। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের আই কিউ প্রায় ৬৮% মানুষ মধ্যম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। ১১৫-১২৯- বুদ্ধিমত্তা উন্নত ধরনের। মধ্যম শ্রেণির ১৩০-১৪৪ – গিফটেড মানুষ, প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। পৃথিবীতে এ রকম সৌভাগ্যবান মানুষ খুবই কম আছে, মানুষদের থেকে বেশি। পৃথিবীতে এই আই কিউ মানুষের সংখ্যা ১৪%। মাত্র ২%। ১৪৫ বা তার চেয়ে বেশি তাহলে এক্সেপশনালি গিফটেড। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একজন জিনিয়াস। মূলত যাদের আই কিউ স্কোর ১৪০-এর বেশি তাদের জিনিয়াস বলা হয়। যেমন- মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। যার আই কিউ ছিল ১৬৫।

এছাড়া প্রায় সব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আছেন এই গ্রুপে। পৃথিবীতে মাত্র ০.১% মানুষ আছেন যারা এ স্কোর করতে পারেন। এই প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা যে কাউকে নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে সাফল্য লাভ করতে হলে শুধু বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং কঠোর পরিশ্রমেরও সমান প্রয়োজন রয়েছে। কথিত আছে- ‘Hard Work Beats Intelligence When Intelligence Doesn’t Work Hard. যদিও বুদ্ধিমান হলেই জ্ঞানী হবে তা নয়, তবুও সবাই বুদ্ধিমান বা ধীমান হতে চায়। যাদের আই কিউ স্বাভাবিক বা কম তারা চেষ্টা করলে তার বুদ্ধিমত্তার
কিছুটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারেন। তবে সে জন্য দরকার প্রচণ্ড উদ্দীপনা, অধ্যবসায়, আবেগ ও
স্বতঃস্ফূর্ততা।

Previous articleমনে হয় আমার ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই , সব সময় আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখি
Next articleশিশু শিক্ষা অপরিণত মনে বাড়তি চাপ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here