শিশুর নারী হয়ে ওঠা

0
9
শিশুদের মন ভালো রাখতে পোষা প্রাণীর ভূমিকা

ডা. শাহানা পারভিন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ, ঢাকা।

শুভ্রার বেবী শাওয়ারে ড্রেস কোড দেয়া হয়েছে পিংক। সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে এ কালারের শাড়ি অথবা জামা পরে যেতে। অর্থাৎ শুভ্রা একজন কন্যা শিশুর জন্ম দিতে যাচ্ছেন। বিষয়টি আনন্দ উদযাপনের একটি উপলক্ষ্য হলেও এর মধ্য দিয়েই বপন হয়ে গেলো একটি অনাগত শিশুর জন্য ভিন্নতার বীজ।

যেকোনো মানবশিশুর বেড়ে ওঠার দুটি দিক- শারীরিক ও মানসিক। শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বৃদ্ধি দুটিই পরস্পরকে প্রভাবিত করে। বয়সের সাথে সাথে তাদের মধ্যে প্রথাগত কিছু ধারণা তৈরি হতে থাকে।
২-৬ বছর: শিশুদের লিঙ্গভিত্তিক খেলাধুলা ও কাজকর্মের সূচনা হয়ে যায়।৭-১০ বছর: ছেলেমেয়েদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা বন্ধমূল হয়ে যায়। যেমন ছেলেরা উগ্র আর মেয়েরা আবেগপ্রবণ।

অথচ নারী-পুরুষের সমতা একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।অবচেতনভাবে আমরাই শুরু করি বিভাজন। আমরা যবন শিশুর বেলনা কিনতে যাই ভবন সবার শুরুতেই যে ব্যাপারটি মাথায় আসে তা হলো- শিশুটি কি ছেলে নাকি মেয়ে?

যদি ছেলের জন্য কিনতে হয় তাহলে প্রথমেই মাথায় আসে- গাড়ি, বল অথবা পিস্তল এবং মেয়ের বেলায় পুতুল বা কিচেন সেট। স্বভাবতই সেই পুতুলের গোলাপি রঙটাও মাথায় চলে আসে। আর ছেলের জন্য নীল, ধূসর বা সবুজ রঙ। এই চিন্তাভাবনাগুলো শিশুদের ছোট্ট মস্তিষ্কে এখন থেকেই তৈরি করে দিচ্ছে অজানা এক অসামঞ্জস্য। সে বুঝতে শিবছে তার জন্য কোন রঙটা প্রযোজ্য। তার মস্তিষ্ক একটা বাঁধাধরা নিয়মে আটকে যাচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর একজন গবেষক সুই পিং ইয়েং তাঁর এক গবেষণায় বলেন যে, ‘এই রঙ-বৈষম্য নিঃশব্দে শিশুর মস্তিষ্ককে নাড়া দেয়। গোলাপি রঙ এবং নীল রঙের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে যা তার মধ্যে নারী-পুরুষের সমতার চেয়ে বিভেদের শিক্ষাটা আগে দেয়।’

এতে করে তার বৃদ্ধি বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। সে একটি নির্দিষ্ট লাইনের বাইরে চিন্তা করতে শিবছে না। এমনকি তার জানার আগ্রহও তৈরি হচ্ছে না। এছাড়াও তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই খেলাধুলা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই শিশুটি ‘মেয়েদের’ এবং ‘ছেলেদের’ বিষয়গুলো আলাদা করতে শিখছে যা কিনা শিশুর বড় হওয়ার সাথে সাথে চারপাশ এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করে।Magazine site ads

মিডিয়ার প্রভাব

এ ধারণাগুলো সমাজে ও পরিবারে প্রোথিত হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। এতে পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি মিডিয়াও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে মেয়েশিশুদের পিংক অথবা কিউট এবং ছেলেদের জন্য নীল, ধূসর ও রাফ এ্যান্ড টাফের বাইরে বিকল্প চিন্তার সুযোগ কমে যায়।

এই লিঙ্গভিত্তিক একঘেয়ে তথ্যগুলো প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় অনলাইন, টেলিভিশন, গেম, গান ও বই-এ তাদের শেবাচ্ছে- আমি মেয়ে, আমি ছেলে। বাসায় ও স্কুলে যথাক্রমে বয়স্ক ও শিক্ষকরাও প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে এ ধারণা প্রোথিত করে দেয় যে, ছেলেরা ছেলের মতো এবং মেয়েরা মেয়ের মতো আচরণ করবে- যাকে বলে সমাজ। কর্তৃক নির্ধারিত ভূমিকা।

সামঞ্জস্য: প্রয়োজন আছে কি?

প্রশ্নটি আসতেই পারে। মনে হবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে। আসলে প্রয়োজন আছে। পরিবর্তনটা হবে ধীর গতিতে। লেগে যেতে পারে শতবর্ষের অধিক। কারণ আজকের মেয়ে শিশুরাই আগামীকালের নারী। আজকের মেয়ে শিশুটি সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করলে, সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ পেলে পরবর্তীতে সে নিজেও সমতামূলক আচরণ করবে।

যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সমাজব্যবস্থায় নারী ও পুরুষ একই স্থানে অবস্থান করে একই কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করবে, একই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে, বিনিময়ে একই মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে এটাই সবার নিকট প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

তবে যেসব দেশে নারীরা গ্লাস সিলিং বা তথাকথিত এই প্রথা ভাঙতে পেরেছেন, সেখানে অন্য নারীও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আর সেসব দেশে নারীদের জীবনের মানও বদলেছে বেশি। যেমন- ভারতে ২০১২ সালে কয়েক হাজার পরিবারে এক গবেষণা চালানো হয়। তাতে দেখা গিয়েছে যেসব গ্রামে অন্তত দুটি নির্বাচনে নারী নেতৃত্ব ছিল সেবানে ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে এই বিভেদ ২৫% কমে গিয়েছে।

প্রায় প্রতিটি দেশেই দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য কিছু গোঁড়ামি। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরি, সম্পত্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে সহজে বিবেচিত হয় না। মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো উপড়ে ফেলা যাচ্ছে না বলে সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। মেয়ে শিশুর প্রতি অসমতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিক অধিকারের প্রতিও অবমাননা।

বৈষম্যের কারণে মেয়ে শিশু পড়ালেখা থেকে ঝরে যায়, বাল্যবিবাহের শিকার হয়; ফলে অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করে, বাড়ে মাতৃমৃত্যুর হার। বাল্যবিয়ের অন্যতম একটি কারণ মেয়েদের মূল্যহীন ভাবা এবং এ কারণে বাবা-মা দ্রুত তাদের দায়িত্ব পালন করে মুক্ত হতে চায়। এর সাথে আছে দারিদ্রদ্র্য, কুসংস্কার ও অশিক্ষা; আছে সন্তান উৎপাদনের অগ্নিপরীক্ষা। পনেরো বছরের নিচে মাতৃমৃত্যুর হার বিশ বছরের চেয়ে অনেক বেশি।মনের খবর ম্যগাজিনে

আজই শুরু হোক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

‘পুড়লো কন্যা উড়লো ছাই, তবেই কন্যার গুণ গাই প্রচলিত একটি বাক্যেই বোঝা যাচ্ছে মেয়ে শিশুদের বেড়ে ওঠার পথ কতটা বন্ধুর। সতীত্ব প্রমাণে তাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। তাই জন্মলগ্ন থেকেই অভিভাবকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতি সতর্কতার সাথে প্রথাগত শিক্ষা দিতে থাকেন।

দুরূহ হলেও পরিবর্তন একদিন আসবেই। সামঞ্জস্যের কাজটি শুরু করতে হবে জন্মের প্রথম দিন থেকে। কারণ ১০-১২ বছরে গিয়ে হঠাৎ একদিন শুরু করতে চাইলে তা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। প্রথম থেকেই। শিক্ষক এবং অভিভাবকের উচিৎ প্রথাগত আচরণ, লিঙ্গবৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করা। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সামঞ্জস্যের বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারেন। তাদের কোনো আচরণের ব্যাখ্যা, অজুহাত যেন লিঙ্গভিত্তিক না হয়।

যেমন, বেটাছেলের কাঁদতে নেই, মেয়েদের রাগতে নেই- এ ধারণাটির পরিবর্তে আমরা তাদের আনন্দ- বেদনার বহিঃপ্রকাশগুলো সঠিক উপায়ে প্রকাশ করতে সাহায্য করতে পারি। ছেলেরা দুষ্ট-হুল্লোড়ে কিংবা মেয়েরা শান্ত-মিষ্টি এ ধরনের কথাগুলো এড়িয়ে গেলে ভালো হয়। পিতার দায় হিসেবে নয়, কন্যা শিশু দৃঢ়-আত্মত্মবিশ্বাসী-দয়ালু এবং অন্যের দুঃখ-কষ্টের সাথে একাত্ম অনুভব করার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠুক। ছেলেদের-মেয়েদের মতো পোশাক এ ধরনের চিন্তা- ভাবনাকে এড়িয়ে পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে শেখাতে হবে।

প্রতিদিনের ঘরের কাজগুলো প্রতিটি শিশুকে অদল-বদল করে দিলে ছেলেমেয়ে উভয়ে সব কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। বেলার সময় মেয়েলি বেলা অথবা ছেলেদের বেলা এসব চিহ্নিত না করে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বেলার চর্চা করানো ভালো। আরেকটি উপায় হচ্ছে আপনি তাদের প্রচলিত ধারণাগুলো জানাবেন কিন্তু পাশাপাশি বিপরীত ভূমিকার প্রশিক্ষণ দিন, ধারণা দিন, জানিয়ে দিন, শিবিয়ে দিন। আমরা তাদের প্রতিদিন একজন বীর নারী- পুরুষ বা একজন মহৎ মানুষের গল্প শোনাতে পারি। তাদের জন্য বই, গল্প ও বেলার সামগ্রী এমনভাবে নির্বাচন করুন যা তাদের ভালো কাজ ও আচরণ করতে উৎসাহিত করবে, বিপদে সাহস যোগাবে।

তাদের ছেলে বা মেয়ে হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখুন এবং তাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো অনুসরণ করুন। অনুভব করতে শেখান যে, কোনো কাজই অন্য কাজ থেকে উচ্চতর কিংবা নিম্নতর নয়। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন, যেকোনো কাজ ছেলের বা মেয়ের হওয়া মানে এই নয় যে, এটি অন্য লিঙ্গের জন্য নিষিদ্ধ। ধারণা দিন, একজন মেয়ে চেষ্টা করলেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী, লেখক, ফুটবলার অথবা ব্যবসায়ী হতে পারে।

তাদের জন্য কোনটি নিরাপদ, কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ তা ছোটবেলা থেকেই জানতে হবে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও আত্মত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পরিবার থেকেই বাল্যবিবাহকে না বলতে হবে। তাদের শিক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা উপার্জনক্ষম হবে এবং পরিবারের পাশে দায়িত্বশীল সন্তানের মতো দাঁড়াবে। তাই রাজকন্যা বা রাজপুত্রের লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ে নয়, আমাদের শিশুরা বড় হবে মানুষ হিসেবে আর পালন করবে সমাজের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা, এটাই প্রত্যাশা।

  • এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
  • চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
    মগবাজার রেইল গেইট।
    নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
    (ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
    চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০

আরও পড়ুন-

Previous articleকিভাবে বুঝবেন, অটিজম নাকি বিকাশজনিত অন্য কোনো সমস্যা
Next articleআমি অনেক হতাশায় থাকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here