যেভাবে বাড়ে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা

যেভাবে বাড়ে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা

জীবনে সুখ ও সফলতা লাভের জন্য প্রয়োজন আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার। আমরা অনেক সময়ই দেখি কোনো কোনো ব্যক্তি পড়াশুনায় অনেক ভালো হওয়ার পরও তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, এমনকি পেশাগত জীবনে ব্যর্থ হয় শুধু আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাবে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গঠনে, কাজের ক্ষেত্রে সফলতা ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বলতে আমরা কি বুঝি?

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা হলো ব্যক্তি তার নিজের এবং অন্যদের আবেগীয় অবস্থা (রাগ, দুঃখ, ভয়) সনাক্ত করতে ও বুঝতে পারবে। পাশাপাশি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইতিবাচক ভাবে পরিচালনা করে, অন্যের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন ও যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ৪টি নির্ধারক হলো

আত্মসচেতনতা: এর অর্থ ব্যক্তি তার নিজের আবেগকে বুঝতে পারে এবং কিভাবে এই আবেগ তার চিন্তা ও আচরণকে প্রভাবিত করছে সে সম্পর্কে সচেতন থাকে। তিনি কিসে যোগ্য এবং কোথায় কোথায় তার দুর্বলতা আছে এ বিষয়গুলো জেনে তিনি আত্মবিশ্বাসী হন।

আত্মনিয়ন্ত্রণ: অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও আচরণকে (যেমন অতিরিক্ত রাগে সবার সামনে চিৎকার করা) নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তি সুস্থ পন্থায় তার আবেগকে পরিচালনা করে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। অর্থাৎ যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

সামাজিক সচেতনতা: এক্ষেত্রে ব্যক্তি অন্যদের আবেগ ও চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে। যেমন ‘বস‘রেগে আছেন, সেই মুহূর্তে জরুরি কোনো কাজ নিয়ে ‘বস’ এর সামনে উপস্থিত না হয়ে পরবর্তীতে আবেগীয় অবস্থা ইতিবাচক হলে তার সামনে যাওয়া।

সম্পর্ক গঠন বজায় রাখা: এক্ষেত্রে ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারদর্শী থাকে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি অন্যদের উৎসাহিত ও প্রভাবিত করতে, দলের মধ্যে কাজ করতে এবং যে কোনো দ্বন্দ্ব সহজেই নিরসন করতে পারে।

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা আমাদের কর্মক্ষেত্র, পারস্পরিক সম্পর্ক, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাবে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এসব ক্ষতি আমাদের ধীরে ধীরে একজন ব্যর্থ ও অসুখী মানুষে পরিণত করে।

আমরা চাই শত ত্যাগের বিনিময়েও আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সফলতায় ভরে উঠুক। আর তাই পিতা-মাতাই পারেন ছোট বেলা থেকেই সন্তানের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলা ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে।

শিশুদের মধ্যে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা তৈরির উপায়

শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি মতামতকে গ্রহণ করা গুরুত্ব দেওয়া: গুরুত্ব দেওয়ার মানে এই নয় যে তার সব কিছুই মেনে নিতে হবে। এর মানে এই যে শিশুটিকে বুঝতে দেওয়া যে আমরা তার অনুভূতিগুলোকে ঠিক তার মতো করেই বুঝতে পারছি। আমরা জানি আমাদের কোনো আবেগ যখন কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় তখন কতোটা ভালো লাগে। ঠিক একইভাবে শিশুদের যখন কেউ বুঝতে পারে তখন সেও খুব ভালো অনুভব করে এবং তারাও অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতকে সম্মান করতে ও গ্রহণ করতে শেখে।

যখন শিশুর আবেগ জনিত বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্যতা পায় তখন শিশু তার নিজের আবেগকে মেনে নিয়ে সেটা সমাধান করা এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে।

শিশুর আবেগীয় প্রতিক্রিয়াকে প্রকাশ করতে দেওয়া: অনেক সময় আমরা বাচ্চাদের বিভিন্ন আবেগ প্রকাশে বাধা দিয়ে থাকি। যেমন: এতো কান্না করা বা রাগ করা ভালো না, কান্না থামাও, রাগা-রাগি করবে না। এতে  বিষয়গুলো থেকে সে বিরত থাকে না, সাময়িক সময়ের জন্য সে হয়তো থেমে যায়।

এ আবেগগুলো তখন তার অবচেতন মনে জমা হতে থাকে এবং পরবর্তীতে এগুলোই জমে জমে বড় আকারে প্রকাশ পায়। তাই শিশুদের ছোট ছোট আবেগ গোঁড়া থেকেই প্রকাশ করতে দেওয়া উচিৎ। সাথে সাথে অনেক ক্ষেত্রে বেশি বাড়াবাড়ি না হলে মেনে নেওয়া উচিৎ।

শিশুর কথা আবেগ জনিত বিষয় মনোযোগ দিয়ে শোনা: অনেক সময় আমরা বাচ্চাদের অনেক আবেগ অযৌক্তিক বলে একেবারেই শুনতে চাই না বরং থামিয়ে দেই। এতে তার আবেগ প্রকাশ হওয়ার পরিবর্তে ভেতরেই থেকে যায় এবং সময় সময় অযৌক্তিকভাবে তা প্রকাশিত হয়।

আমরা অনেক সময় দেখি ব্যক্তি একই কথা বারবার বলে। তিনি অতীতের ফেলে আসা কোনো কষ্টের কথাই ভোলেন না। কারণ তার কষ্টের অনুভূতিগুলো সময় মতো সঠিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। মনোযোগ দিয়ে শোনার মাধ্যমে কষ্টের অনুভূতিগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সময় মতো সঠিক প্রকাশিত হতে পারে।

সমস্যা সমাধান জানানো: শিশুরা তাদের আবেগ প্রকাশের সাথে সাথে কিভাবে তার সমাধান করবে সে সম্পর্কে জানতে চায়। ধরা যাক, একটি শিশু তার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল, সে এলে একসাথে খেলবে। কিন্তু বন্ধুটি না আসায় শিশুটি খুব হতাশ হলো।

এ সময় তার বাবা-মা তাকে বলতে পারেন যে ‘আমরা বুঝতে পারছি যে তোমার বন্ধু না আসাতে তুমি খুব হতাশ হয়েছ, তবে এই সময়টা তুমি অন্য ভাবে মজা করতে পারো’। যেমন- কিছু ভালো কার্টুনের সিডি আছে সেটা দেখেও মজা পাওয়া যেতে পারে।

এতে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে খাপ খাওয়ানোর প্রবণতা তৈরি হবে এবং যেকোনো অপ্রাপ্তিকে সে সহজে মেনে নিতে শিখবে।

খেলার মাধ্যমে আবেগের প্রকাশ: বড়দের মতো ছোটরা সব কিছু ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। খেলার মাধ্যমে তারা তাদের মনের অনেক দ্বন্দ্ব, অস্বস্তি ও আবেগ প্রকাশ করে। এইভাবে অস্বাস্থ্যকর আবেগকে ভেতর থেকে বের করে দেওয়ার মাধ্যমে শিশু তুলানামূলকভাবে কম সমস্যায় আক্রান্ত হয়, শান্ত ও গঠনমূলকভাবে গড়ে ওঠে।

যা তাকে পরবর্তীতে যে কোনো দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়তা করে। তাই অনেক দায়িত্বের পাশাপাশি শিশুকে খেলার সুযোগ করে দেওয়াও প্রতিটি মা-বাবার কর্তব্য।

এভাবে প্রতিটি মা-বাবা পারেন শিশুর মধ্যে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বিকাশের মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ সহজ, সুন্দর ও সফল ভাবে গড়ে তুলতে।

Previous articleখেলার মাঠে সাকিব কেন স্ট্যাম্প ভাঙলেন?
Next articleমায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ যখন হিংস্রতায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here