মানসিক সমস্যা সৃষ্টিতে ওভারপ্রোটেকটিভ প্যারেন্টিং

ডা. সৃজনী আহমেদ

চেম্বারে ঢোকার সময় থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছেলেটা মায়ের হাত ধরে বসে আছে। যেই প্রশ্নই করি মায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়। মা আর বাবা দুজনে মিলে একটা নিরাপত্তার বলয় যেন দৃষ্টি দিয়ে তৈরি করে রেখেছেন।

যখন জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বন্ধু কয়জন? তখন ছেলের মুখটাও বেদনায় কুঁচকে গেল, আর বাবা-মাকে দেখে মনে হচ্ছিল কেঁদে ফেলবেন। নির্লিপ্তভাবে কিছু সময় পার করলাম। কারণ বুঝলাম এখানে কোনো সমস্যা ছেলেটার আছে।

বাবা-মা-ই উত্তর দিলেন বন্ধু সংখ্যা শূন্য। ক্লাসের কোনো ছেলের সঙ্গেই মিশতে পারে না দশ বছরের সামি। খেলার মাঠে গেলে ভয় পায়, পাঁচ মিনিট পর দৌঁড়ে চলে আসে বাসায় মায়ের কাছে। ঘরের মধ্যেও এক ঘর থেকে আরেক ঘরে একা যেতে ভয় পায়।

স্কুলের সময়টা খুব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে পার হয় তার। অন্য বাচ্চারা যেখানে নিজেদের ভেতর খেলা, গল্প এসবে মেতে আছে সামি ভয়ে চুপচাপ এক কোণায় বসে থাকে। ক্লাসে শিক্ষক পড়া ধরলে একদম পারবে এমন জিনিসও না কেঁপে সে বলতে পারে না।

অন্য সব বাচ্চারা তাকে নিয়ে হাসে এবং এই ভয়ে সামি স্কুলেও খুব একটা যেতে চায় না। একজন আত্মীয়ের পরামর্শে সামিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন মা-বাবা।

আরো কিছু রুটিন প্রশ্ন করে জেনে নেই সামির বেড়ে ওঠার ইতিহাস। সামির জন্মের পর পর উদ্বিগ্ন প্রকৃতির মা এক মূহুর্ত ছেলেকে চোখের আড়াল করতে পারতেন না। বাবাও একই আচরণ করতেন। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রকমটা আরো বাড়তে থাকে।

যেকোনো জায়গায় সামির নিরাপত্তা আর সুবিধার দিকে কড়া নজর রাখেন তারা। এক কথায় ছেলের গায়ে রোদের আঁচও যেন না লাগে সেই বিষয়ে তারা খুবই তৎপর। যার ফলে সামিও সব কিছুতে বিপদ খুঁজে পায় এবং ভয় পায়। সামাজিক পরিবেশে হীনম্মন্যতায় ভোগে, সমবয়সীদের মধ্যে নিজেকে একদম বেমানান বোধ হয় তার। সামির বাবা-মাকে বুঝিয়ে বললাম এরকম হেলিকপ্টারের মতো অভিভাবকত্বই ওর সমস্যার কারণ।

অভিভাবক মাত্রই সন্তানের সুরক্ষার কথা ভাববেন এটা খুব স্বাভাবিক। সন্তানের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সুরক্ষা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বিষয়টা যদি মাত্রার মধ্যে না থাকে তাহলেই সমস্যা শুরু হয়। এই ধরনের অতিরক্ষণশীল অভিভাবকত্বকে বলা হয় ওভারপ্রোটেকটিভ প্যারেন্টিং।

সহজভাবে বললে অভিভাবক যখন সন্তানের বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীনভাবে রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করেন এবং নিজেদের মতো করে সন্তানের জন্য সবকিছু বিপদ হিসেবে দেখেন আর সেগুলো থেকে রক্ষার জন্য অতি তৎপর হয়ে ওঠেন তাহলে সেটা ওভারপ্রোটেকশন।

সন্তানের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক যেকোনো ক্ষেত্রে অনেকটা যেন কুশনের মতো তাকে রক্ষায় মরিয়া থাকেন এই বাবা-মায়েরা। সন্তানকে কোনো ব্যথা পেতে দেন না, ব্যর্থতা মানতে চান না ব্যর্থ হলে সেটার জন্য অন্যদের দোষারোপ করেন, নিজেরাই ঠিক করে দেন সন্তান কীভাবে চলবে, কী করবে যাতে তাদের ধারণা অনুযায়ী সন্তান নিরাপদে থাকে এভাবে নিজেদের একটা নিরাপদ বলয় তৈরি করে ফেলেন।

সাধারণত নিজেদের উদ্বিগ্নতা, নিজেদের জীবনের কোনো দুঃসহ অভিজ্ঞতা, গণমাধ্যমের প্রভাব, নিজেদের ব্যক্তিত্বের সমস্যা থেকে এরকম অভিভাবকত্ব হয়।

এই ধরনের অভিভাবকত্ব যেই সমস্যাগুলো তৈরি করে:

সব বাঁধা বিপত্তিকে বাবা-মা নিজেরা পার করে দেয়াতে সন্তানটি তার বয়স অনুযায়ী বিকাশ প্রাপ্ত হতে পারে না। কোনো জটিলতাকে নিজে সমাধান করার জন্য পরিশ্রম করা, মেধা খাটানো এসবে পিছিয়ে থাকে।

আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে। নিজের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে ধারণা হওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না। এক সময় হীনম্মন্যতায় ভোগে।

ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে না। মা-বাবা সবসময় সব কিছু সহজ করতে গিয়ে এই প্রয়োজনীয় শিক্ষা থেকে সন্তানটি বঞ্চিত হয় যে সফলতার মতো ব্যর্থতাও জীবনের অংশ। তাই সন্তানটিও এক সময় ব্যর্থতা ভয় পায়।

সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে না। সামাজিক ভীতি কাজ করে। কারণ এই বাবা-মায়েরা নিজেরা ঠিক করে দেন কার সঙ্গে মিশবে বা মিশবে না। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বন্ধু-বান্ধব তৈরি করে দেন। যাদের পছন্দ হয় না তাদের থেকে সন্তানকে দূরে রাখেন, সন্তানকে খুব বেশি সামাজিক পরিবেশে নিতেও চান না। এর ফলে সন্তানটি সামাজিক ভীতি নিয়ে বেড়ে ওঠে।

আত্মমগ্ন এবং আত্মপ্রেমী হিসেবে বেড়ে উঠে। বাবা-মায়ের মনোযোগের কেন্দ্রবৃন্দ হয়ে থাকতে থাকতে নিজের সম্পর্কে একটা ভ্রান্তিমূলক উচ্চ ধারণা তৈরি হয়ে যায়।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে বাতিঘর বাবা-মা হওয়া। সন্তানকে বাবা-মা যত্ন দেবেন, স্নেহ দেবেন আবার বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে দেবেন। অর্থাৎ নৌকা চালাতে দেবেন। সন্তান সেটাতে সমস্যায় পড়লে অর্থাৎ পথ খুঁজে না বাবা-মা বাতিঘরের মতো আলো দেখাবেন। যাতে সন্তান নিজেই তরী বেয়ে তীরে পৌঁছতে পারে।

ডা. সৃজনী আহমেদ

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleঅটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এবং ইন্টেলেকচুয়াল ডিসএবিলিটির সূক্ষ্ম পার্থক্য
Next articleবিষয়টা লজ্জাজনক হওয়াতে বলতেও পারছি না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here