মানসিক রোগ নিয়ে ধারণা, ভুল ধারণা এবং বিবিধ-পর্ব ৬

বসে আছি হাসপাতালের একটি কক্ষে। টেবিলের ওপাশে একজন ভদ্রলোক। হতাশ, বিষণ্ণ, বিধ্বস্ত একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি যেন। ন্যুব্জ দেহভঙ্গি, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। একসময় সরকারী কলেজে পড়িয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র। সদ্য কৈশোর পেরুনো কত কোমল কিন্তু জিজ্ঞাসু মনের সন্দেহ দূর করেছেন যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন কত জটিল জটিল তত্ত্ব।
কিন্তু, সে মানুষটা আজ যেন হারিয়ে গেছে। নিজেই আজ অবুঝ, কোন ভাবেই বুঝতে পারছেন না আমার কথা। কারণ, এই মাত্র জানতে পারলেন তাঁর একমাত্র সন্তান একজন মানসিক রোগী।
আমার টেবিলের ওপাশে আসার আগেই অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। নিজের মনেও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, সেই সাথে অন্যান্য চিকিৎসকদের মাধ্যমেও শুনেছেন – তাঁর সন্তান মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবু, মনের গহীনে একটু শেষ আশা ছিল। এখানে হয়তো অন্য কোন কথা শুনতে পাবেন। হয়তো জানতে পারবেন, আসলে কিছুই হয়নি – তাঁর সন্তান মানসিক রোগী না। কিন্তু, সেই শেষ আশাও শেষ হয়ে গেল। এই মুহুর্তে তাই তিনি বিহ্বল, হতভম্ব।
কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলেন ভদ্রলোক।
– ডাক্তার সাহেব, আপনি এ কি শুনালেন! শেষ বয়সে এসে এই কথা শোনার জন্যেই কি আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেন।
– আঙ্কেল, আপনি ব্যাপারটা এভাবে নিচ্ছেন কেন? এটাতো মোটেই সেরকম কোন ব্যাপার নয়।
– আপনাকে কি ভাবে বুঝাই বলেন। আমার এমন যুবক বয়সের ছেলে অচল – পাগল হয়ে জীবন কাটাবে। বাবা হয়ে কিভাবে আমি তা মেনে নিব বলেন!
– আহা, মানসিক রোগী হলেই যে একজন মানুষ অচল হয়ে যাবে, কিংবা তাকে পাগলই হতে হবে এ ধরণের কথা আপনাকে কে বলল।
– এটা ঠিক যে, আমি এ ব্যাপারে আপনার মতো জানিনা । কিন্তু, দেখছি তো আশেপাশে। আমি তো সমাজের বাইরের মানুষ নই।
আমার সামনে সমাজের আর দশজন মানুষ আমার ছেলেকে পাগল বলবে, আর আমাকে তা চুপ করে সহ্য করতে হবে। যে ছেলে ভাল ছাত্র হিসেবে ছিল সবার চোখের মণি, সেই সাথে ভদ্র-বিনয়ী আচরণের জন্য পাড়ার সবাই যাকে বলত হীরের টুকরা- সেই ছেলে এখন সবার সামনে পাগলামি করে বেড়াবে। আর নয়ত ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। তার না হবে কোন চাকরি-বাকরি, না হবে বিয়ে। সমাজে না পাবে কোন সম্মান-এমনকি বাপের সম্পত্তিও পাবে কিনা সেটা আদালতের ব্যাপার।
– আপনি কি বুঝতে পারছেন- আমি কোন খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি?
– এখনি এত ভেঙ্গে পড়ার কিছুই নেই। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু আমি এও জানি সঠিক তথ্য জানতে পারলে আপনার নিজেরই অনেক ভুল ধারণা ভাঙবে, আর আপনার কাছ থেকে শুনে-জেনে আপনার চারপাশের লোকগুলোর-ও মনোভাব পরিবর্তিত হবে।
– ভুল ধারণা! কোনটাকে আপনি ভুল ধারণা বলছেন?
– এই যে, আপনাকে বললাম আপনার সন্তানের একটা মানসিক রোগ আছে এবং এটা একসময় ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি তা মানতে পারছেন না। কারণ, আপনার ধারণাতে আছে মানসিক রোগ কখনো ভাল হয় না। কি ঠিক বলেছি তো?
– আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু, আমার ধারণাটা ভুল কেন? নিজের চোখেই তো দেখি গ্রামের কত পাগল –মানে আপনাদের ভাষায় মানসিক রোগী – আজীবনই ভুগে যাচ্ছে।
– দেখুন, মানসিক রোগ মানেই নিরাময় অযোগ্য তা কিন্তু ঠিক নয়। এ রোগগুলোর অধিকাংশই চিকিৎসায় ভাল হয়ে যায়।
– তাহলে, ‘ভাল হয় না’ এ কথাটি কি এমনি এমনি তৈরি হয়েছে?
– এই ধারণা গড়ে উঠার পিছনে কিছু কারণ তো অবশ্যই আছে। তবে, সেখানে স্বাভাবিক ঘটনার ভুল ব্যাখ্যাটাই মূল ভূমিকা পালন করেছে।
হয়েছে কি, আমরা সাধারণত প্রচলিত কথাতেই বেশী আকৃষ্ট হই। নিজে থেকে খুঁজে দেখার, ভেবে দেখার কিংবা পড়ে জানার মতো ইচ্ছা, অভ্যাস বা সময় কোনটাই আমাদের নেই। যদি এটা থাকতো তবে এই ভুল ধারণাটা এত ডালপালা মেলতে পারত না।
– বুঝলাম না।
– তাহলে ভেঙ্গেই বলি। প্রথমতঃ মানসিক রোগীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ চিকিৎসার আওতায় আসেই না। অতএব, তাদের ভালো হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
দ্বিতীয়তঃ অধিকাংশ মানসিক রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু, অনেকেই এটা জানেন না বা বুঝেন না। তাঁরা সাধারণ শারীরিক সমস্যা, যেমন – জ্বর-সর্দি-কাশির মতোই মানসিক রোগের চিকিৎসাতেও কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহেই সুস্থতা আশা করেন। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেন। রোগ আর নিরাময় হয় না।
তৃতীয়তঃ বেশ কিছু রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করলেই আনন্দিত হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। ফলে ঔষধের প্রভাব কাটতেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চতুর্থতঃ কিছু মানসিক রোগ আছে, যেসব স্বাভাবিক নিয়মেই বারবার ফিরে আসে বা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে, রোগের পুনরায় আবির্ভাব ঘটলে হতাশ হয়ে পড়ে রোগী এবং রোগীর লোকজন।
পঞ্চমতঃ মানসিক রোগের ধারাবাহিক সুস্থতা অনেক সময় নির্ভর করে অনেকগুলো ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক নিয়ামকের উপরেও। যেমন – একজন বিবাহিত মহিলা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অসহযোগিতার কারণে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হলেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থও হলেন। কিন্তু, শ্বশুরবাড়ির অসহযোগিতার যদি কোন পরিবর্তন না হয় এবং তাকে সেখানেই থাকতে হয়– তবে মহিলার বিষণ্ণতা সম্পুর্ন ভাল হওয়া যথেষ্ট দুরূহ।
– ওরে বাবা! এত কিছু!
– সেটাই তো বলতে চাইছি।
– হুম। কিন্তু, কিছু রোগ তো আছেই যেগুলি ভালো হয় না।
– হ্যাঁ, আছে। তবে সংখ্যায় কম।
– ডাক্তার সাহেব, আপনি আমার ছেলের মত। আমাকে দয়া করে সত্যিটা বলুন। আমার ছেলে কি আদৌ ভাল হবে, নাকি আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
– মিথ্যা সান্ত্বনা দিব কেন?
– যাদের রোগ ভালো হবেনা বলে বুঝতে পারেন তাদেরও নিশ্চয়ই আমার মতো করেই সান্ত্বনা দেন। তাই না?
– হা হা হা। না আঙ্কেল, এত ভয় পাবার কিছু নেই। যাদের রোগ জটিল এবং পুরোপুরি হয়তো ভাল হবে না বলে ধারণা করি, তাদের কে আমরা সত্যি কথাটাই বলি। তবে, কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতেই হয়। এটার উদ্দেশ্য হল- যাঁকে বলা হচ্ছে তিনি যাতে মনোবল না হারিয়ে সত্যিটাকে গ্রহণ করতে পারেন। তবে, নিশ্চিত থাকুন, কাউকে ভাল রাখার জন্য আমরা কোন ভাবেই মিথ্যা তথ্য বা মিথ্যা আশ্বাস দিই না।
– আহারে, যারা জেনে যায় রোগ ভাল হবে না তাদের কত কষ্ট! তারপরও চিকিৎসার নামে কিছু সান্ত্বনা নেয়া।
– এই কথা কেন?
– না মানে, সুস্থ হবে না জেনেও চিকিৎসা করার আর কি অর্থ?
– অর্থ তো অবশ্যই আছে। তবে সেজন্য আগে বুঝতে হবে-‘সুস্থ হবে না’ বলতে আপনি আসলে রোগ নির্মূল না হওয়াকেই বুঝাচ্ছেন। রোগের মাত্রা কমাটাও কিন্তু এক প্রকার সুস্থতা।
– একইসাথে আরেকটা ব্যাপার বুঝতে ও মানতে হবে যে, শারীরিক রোগের মত মানসিক রোগের গতিপ্রকৃতিও একই রকমের। শারীরিক রোগের সাথে তুলনায় মানসিক রোগ ভিন্ন কিছু নয় এবং কম গুরুত্বপুর্ণ বা হালকা কোন ব্যাপারও নয়। সব শারীরিক রোগ যেমন ভালো হয় না – মানে নির্মূল করা যায়না, তেমনি সব মানসিক রোগও নির্মূল করা যায় না।
অতএব, যে কারণে অসংক্রামক রোগে (Non-communicable diseases) আক্রান্ত রোগীরা; যেমন -হৃদরোগ, এ্যাজমা বা হাঁপানি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, সোরিয়াসিস প্রভৃতি রোগের রোগীরা; রোগ নির্মূল হবে না জেনেও চিকিৎসা নেন – নিয়মকানুন মেনে চলেন, সেই একই কারণে জটিল, দুরারোগ্য কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও চিকিৎসার আওতায় থাকতে হবে, নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
– কি সেই কারণ?
– এই ক্ষেত্রে, চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয় – রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, রোগের আরও জটিল হয়ে উঠা ঠেকানোর জন্য এবং যতটুকু সম্ভব ভাল থাকার জন্য।
– বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে এতকিছু ভেবে দেখিনি। আপনি কিছু মনে করবেন না।
– আঙ্কেল, এটা কোন সমস্যা না। আমাদের কাজই হচ্ছে চিকিৎসার পাশাপাশি এসব ব্যাপার মানুষকে জানানো, বোঝানো। আসল সমস্যা হচ্ছে – ভাবতে না চাওয়া, জানতে না চাওয়া, বুঝতে না চাওয়া।
ভদ্রলোকের সাথে কথা চলতেই থাকে…


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleইন্টারনেট-আসক্তি: সচেতন হোন এখনই
Next articleপ্যানিক ডিজঅর্ডার: ভয় এড়িয়ে মানসিক রোগ থেকে বাঁচুন
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here