[int-intro] এমন একটা সংকটের সময়ে আমরা বাস করছি যখন সভ্যতার অঢেল উপঢৌকন দু’হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েও দ্বিধান্বিত হচ্ছি। হিসেব করতে বসছি লাভের মোড়কে ক্ষতির বিস্তারটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল কিনা। নানারকম চটকদার এবং তড়িৎ যোগাযোগ মাধ্যম মানুষে মানুষে যোগাযোগের সম্ভাবনাকে অবারিত করলেও আমরা প্রবেশ করেছি এক আশ্চর্য মানবিক সংকটের কালে। মানবিক সম্পর্ক বনাম ভার্চুয়াল জগৎ- এমন একটা শিরোনামে ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রকাশের উদ্যোগ সে সংকটকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আজ প্রকাশিত হচ্ছে একজন মায়ের সাক্ষাৎকার- প্রযুক্তির রঙিন থাবা যাঁর সন্তানদেরকে দূরে টেনে নিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মনের খবরের বিশেষ প্রতিবেদক সাদিকা রুমন। [/int-intro]
[int-qs]পেশাগত জীবনে আপনি কী করেন?[/int-qs]
[int-ans name=””]সরকারি চাকরি করি।[/int-ans]
[int-qs]আপনার সন্তান-সন্ততি কয়জন?[/int-qs]
[int-ans name=””]দু’জন- এক ছেলে এক মেয়ে।[/int-ans]
[int-quote]প্রযুক্তি একদিকে সবকিছুকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সাত-সমুদ্র তের নদীর দূরত্ব পার করে মানুষ এখন মানুষের দৃষ্টিসীমায়। তবুও মনে হয় মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে বিশাল দূরত্ব। কখনো কখনো সে দূরত্ব সাত সমুদ্র তের নদীর দূরত্বের চেয়েও বেশি। সবকিছু খুব বেশি সহজ হয়ে যাওয়াটাই এর মূল কারণ। অনেক কষ্ট করে যখন কিছু পাওয়া যায় তখন তার মূল্যায়নটাও সেরকম হয়। যখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি তখন কষ্ট হলেও চিঠি লেখা হতো। আর চিঠির আবেদন ছিল আবেগময় যা পারস্পরিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করত। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিভিন্ন বর বিশেষত ফেসবুক মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে কিন্তু তাতে কেমন অন্তরের স্পর্শ কম।[/int-quote]
[int-qs]বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি-আসক্তি নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা-সমালোচনা হয়- আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?[/int-qs]
[int-ans name=””]এখন তো সময়টাই প্রযুক্তির আধিপত্যের। তাই আমি চাই বা না চাই পছন্দ করি বা না করি প্রযুক্তিকে জীবন থেকে বাদ দিতে পারব না। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের। আর বাদ দিতে আমি বলছিও না। তবে এর ব্যবহারকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ নিঃসন্দেহে। বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির ব্যবহারকে যখন প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রযুক্তির কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দেয় তখন সেটাকে অপব্যবহার বলেই আমি মনে করি। নিশ্চয়ই সেই অপব্যবহার দুশ্চিন্তারই কারণ।[/int-ans]
[int-qs]আপনার সন্তানেরা কী কী ডিভাইস ব্যবহার করে?[/int-qs]
[int-ans name=””]মোবাইল, ল্যাপটপ।[/int-ans]
[int-qs]কতটুকু সময় ব্যবহার করে?[/int-qs]
[int-ans name=””]স্কুল বা প্রাইভেটের সুনির্দিষ্ট সময়ের বাইরে যতটা সময় ঘরে থাকে তার অর্ধেকেরও বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে একজন। আরেকজনের জগতও ভার্চুয়াল কেন্দ্রিক।[/int-ans]
[int-qs]তার মানে ওদেরকে প্রযুক্তি-আসক্তই বলা যায়?[/int-qs]
[int-ans name=””]হ্যাঁ অনেকটাই।[/int-ans]
[int-qs]প্রতিকারের চেষ্টা করেননি?[/int-qs]
[int-ans name=””]করেছি। করে যাচ্ছি। তবে অনেক সময় কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়তে হয়। বুঝে উঠতে পারি না কী করা উচিৎ। আর কী করা উচিৎ না। কোনটাতে সুফল পাব আর কোনটাতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিই। বই পড়তে উৎসাহিত করি, ওদের মতামতগুলো আগ্রহের সাথে শুনি। তবুও যেন মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের সাথে সাথে ছুটতে পারছি না, ওদেরকে ধরতে পারছি না, ওদের পৃথিবীটা চিনতে পারছি না। আমি সবসময় চেষ্টা করি সন্তানদের সময় দিতে। ওরা বাবার কাছ থেকে ছোটবেলায় তেমন সময় পায়নি। এখন ওদের বাবা প্রয়োজনটা বুঝতে পেরে সময় দেয়ার চেষ্টা করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানের নিজেরই সময় হয় না এখন।[/int-ans]
[int-qs]আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কি কখনো এটা মনে হয়েছে যে প্রযুক্তির ব্যবহার মানবিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে?[/int-qs]
[int-ans name=””]প্রযুক্তি একদিকে সবকিছুকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সাত-সমুদ্র তের নদীর দূরত্ব পার করে মানুষ এখন মানুষের দৃষ্টিসীমায়। তবুও মনে হয় মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে বিশাল দূরত্ব। কখনো কখনো সে দূরত্ব সাত সমুদ্র তের নদীর দূরত্বের চেয়েও বেশি। সবকিছু খুব বেশি সহজ হয়ে যাওয়াটাই এর মূল কারণ। অনেক কষ্ট করে যখন কিছু পাওয়া যায় তখন তার মূল্যায়নটাও সেরকম হয়। যখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি তখন কষ্ট হলেও চিঠি লেখা হতো। আর চিঠির আবেদন ছিল আবেগময় যা পারস্পরিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করত। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিভিন্ন বর বিশেষত ফেসবুক মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে কিন্তু তাতে কেমন অন্তরের স্পর্শ কম।[/int-ans]
[int-qs]এরকম বাস্তবতায় আমাদের কী করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?[/int-qs]
[int-ans name=””]যোগাযোগের এইসব মাধ্যম মানবিক সম্পর্কের ভিতকে অনেক ক্ষেত্রেই নড়বড়ে করে দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। অনেকেই এর ভুক্তভোগী। এ অবস্থার সংস্কার করা খুব সহজ নয়। এজন্য চূড়ান্ত ক্ষতির আগেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা সকল বাবা-মা যদি এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে একটা শ্লোগান দিতে পারতাম যে- একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেব না, ফেসবুক বা এজাতীয় অন্যান্য মাধ্যম থেকে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হব তাহলে হয়তো একটা পরিবর্তন ঘটতে পারত। আমার সন্তানদের তো আমি আমার মত করে বড় করেছি, শিক্ষা দিয়েছি, আগলে রেখেছি কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারিনি। কারণ ওদের বন্ধুদের তো আর আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। শুধু বন্ধুরাই কেন শিক্ষকদেরই কেউ কেউ যখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়া দিয়ে ফেসবুক চালায় তখন আমাদের হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ৫/১০ জন মানুষ একসাথে হলে দেখা যায় তারা নিজেদের মধ্যে কথা না বলে ফেসবুকে ডুবে আছে। আবার আড্ডায় বসে দেখা যায় আড্ডার চেয়ে ছবি তোলার দিকেই মনোযোগ। এসবের সাথে একা একা যুদ্ধ করা খুব কঠিন। প্রয়োজন সবার একাত্মতা।[/int-ans]
[int-qs]আপনি প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহারের কথা বলেছিলেন- কীভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে?[/int-qs]
[int-ans name=””]আগেই বলেছি নির্দিষ্ট বয়সের আগে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল, ট্যাব এসব তুলে দেয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আর এ থেকে দূরে রাখার জন্য বাবা-মা উভয়কেই বাচ্চাদের পেছনে সময় দিতে হবে। বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, খেলতে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে নিজেই সন্তানের খেলার সঙ্গী হয়ে যাওয়া- এইসব খুব প্রাথমিক কর্তব্য। এক্ষেত্রে অবশ্যই বাবা ও মা দুজনকেই সক্রিয় হতে হবে। একজন আরেকজনকে ছোট করা, গুরুত্ব কম দেয়া বাবা মায়ের এইসব আচরণ সন্তানের সাথে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বাবা- মায়ের মধ্যে দূরত্ব সন্তানকেও হয়তো দূরে ঠেলে দেয়। তারা অন্য আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবেও ইন্টারনেট ব্যবহারে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত ফেসবুকের মত যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে বয়সসীমা কঠোরভাবে অনুসরণ করা উচিৎ বলে আমার মনে হয়।[/int-ans]
কতটা ক্ষতি হলে ঘুরে দাঁড়াবার সময় আসে তার কোনো পরিমাপ জানা নেই কারো। ভার্চুয়াল জগৎ মানবিক জগৎটাকে গিলে ফেলবার আগেই আমরা যদি সচেষ্ট না হই তাহলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াবার অবকাশই থাকবে না। তাই এখনি সময় ঘুরে দাঁড়াবার। আমাদের সময়গুলো হোক পরস্পরের- সঙ্গীর-সন্তানের-মায়ের-বাবার-বন্ধুর। শুধু আঙুলে আঙুলে নয়, আমরা চোখে চেয়ে কথা বলি রক্ত-মাংসের বন্ধু-পরিজনের।