মন- সাহিত্য রচনার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
সাহিত্যের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যে খুবই ঘনিষ্ঠ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবকিছুর সঙ্গেই মনের সম্পর্ক রয়েছে।
আমরা প্রায়ই একটা কথা বলি, কার মনের খবর কে রাখে। আমরা বলি যে, স্ত্রী লোকের মন, সখা সহস্র বর্ষের ধন। কেউ তার কোনোদিন নাগাল পায়নি, পাবেও না, ঈশ্বর টের পান না, তো মানুষ কোন ছাড়।
আসলে যা দৃশ্যমান নয়, কর্ণগোচর নয়, স্পর্শযোগ্য নয়, যার স্বাদ গ্রহণ করার কোনো উপায় নেই এবং আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোনোটা দিয়ে যা আসে না, অথচ প্রতিনিয়ত যেটার জন্য আমরা বেঁচে থাকার বোধটা পাই সেটাই মন। মন হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের চেতনা।
মানুষ অনেক কাজ করছে, হেটে-চলে বেড়াচ্ছে, একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছে, খাচ্ছে- এসব কিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত মানুষটির মনে কী রকম চিন্তা-ভাবনা চলছে সেটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সেটা যদি দেখতে পাওয়া যেত, শুনতে পাওয়া যেত, ছুঁয়ে দেখা যেত তাহলে মনের ব্যাখ্যা সহজে দেয়া যেত। যেহেতু মন এসব কিছুর ঊর্ধ্বে তাই, তাই মনটা আছে মনে মনে, যার মন আছে সেই বুঝে। তার পাশের মানুষ সেটা বুঝতে পারবে না।
আমি বলি, মানুষ একটা শরীর নিয়ে জন্মায়, মানুষের শারীরিক জীবন যাপনটা দেখতে পাওয়া যায়। শারীরিক জীবন-যাপনের একটা ইঞ্জিন দরকার। শরীরটা চালাচ্ছে কে? শরীরের তো নিজেই কিছু করে না?
আমরা বলি, নার্ভ আছে, মস্তিষ্ক আছে। মস্তিষ্ক শরীর চালাচ্ছে। কিন্তু এতে পুরোপুরি বলা হয় না, এতে মনতৃপ্ত হয় না। বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, মানুষ দৈহিক জীবন যাপন করছে কিন্তু মানুষ আসলে মানসিক জীবন যাপন করে। আর এই জীবনেরই পাদটীকা হচ্ছে মৃত্যু। অর্থাৎ মৃত্যুর সময়ই মানুষের এ চেতনার অবসান ঘটে। যতক্ষণ মানুষের চেতনা আছে ততক্ষণ মনের নিষ্কৃতি নেই, বা বলা যায় মনের হাত থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই।
মন ও সাহিত্যের স্বাদ বুঝতে পারছি, একটা থেকে আরেকটা স্বাদ আলাদা করতে পারছি-মন না থাকলে কিন্তু এটা করতে পেতাম না।
আমি নিজেই ডিপ্রেশনের রোগী। আমি ১৯৭৯ সাল থেকে এ রোগে ভুগছি। এখন অবশ্য সেরকম ভুগি না। তবে এখনও বিশেষ ওষুধ এক ডোজ করে চালিয়ে যাচ্ছি।
আমি বলতে, চাই, যে ডিপ্রেশনে ভুগচ্ছে, তার কষ্টের কথা যেন অন্য কেউ বুঝতে যাওয়ার চেষ্টা না করে। কেননা এটা অন্যের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য। একটা মুহুর্তে কীভাবে সমস্ত পৃথিবীটা বিবর্ণহীন হয়ে যায়, আকাশের নীল চলে যায়, বাতাসের শান্ত শিথিলতা চলে যায়, সমস্ত আনন্দ চলে যায়, প্রেম-ভালোবাসা পর্যন্ত অসহ্য লাগে। এমনকি আলো ভালো লাগে না, শব্দ ভালো লাগে না, ঘরবন্ধ করে দিতে হয়, সন্তান কাছে এলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কারও সঙ্গ ভালো লাগে না।
আমার ধারনা, প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে অল্পস্বল্প ডিপ্রেশনে ভোগে। এটা কিন্তু নতুন নয়। এটা পুরোনো। সুস্থ মানুষের মধ্যেও এটা দেখা যায়। একজন মানুষ নানা কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। দুশ্চিন্তা বাড়তে বাড়তে সেটা একসময় উদ্বেগে পরিণত হয়। সেই উদ্বেগের শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন-হাত পা কাঁপে, বুকে ব্যথা হতে থাকে। কিন্তু এর কোনোটিই শারীরিক নয়, এগুলোর উৎপত্তি মন থেকে।
প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ডিপ্রেশনে ভুগেছেন!
যারা একটু বেশি স্পর্শকাতর তথা বেশি অনুভব ও অনুভূতি সম্পন্ন তারা মনোরোগে বেশি ভোগেন। আমার ধারণা, প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর বড় বড় কবি, সাহিত্যিক লেখক, প্রতিভাবান ব্যক্তি, এমনকি বড় বড় জেনারেলরাও ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। তখন তারা এটাকে রোগ হিসেবে জানতেন না। তখনও হয়ত বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার হয়নি, মনোরোগ শনাক্ত করা যায়নি।
লেখার সঙ্গে, লেখকের সঙ্গে কিংবা সৃজনশীল কর্মের সঙ্গে ডিপ্রেশনের যোগ কতটা তা সহজে বোঝা যায়। আমি বলবো, দস্তেয়েভস্কি অবশ্যই ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। তা না হলে জীবনের অন্ধকারটা এতো গভীরভাবে তুলে ধরা তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
মনে হয়, কবি বোদয়োরও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। তাদের লেখায় উঠে এসেছে জীবনের তিক্ততা, বিবর্ণতা, কষ্ট। মনে হয়, তারা জীবনের কোনো আনন্দ উপভোগ করেন নি।
জুলিয়াস সিজারও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। আরও অনেকে ডিপ্রেশনে কাটিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাও করেছেন কেউ কেউ। ভার্জিনিয়া উলফের মতো সাহিত্যিক আত্মহত্যা করেছেন।
আবার অনেক কবি-সাহিত্যিক ডিপ্রেশনের রোগী হয়েও জীবনটাকে খুব ইতিবাচকভাবে দেখেন। তাই তাদের লেখায় উঠে আসে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো। আমার নিজেরও ডিপ্রেশন যখন থাকে না তখন আমার মতো কেউ হাসিখুশি থাকতে পারে না।
মানুষ বলতে পারে, ডিপ্রেশনের কথা যখন লিখছে তখন লেখক ডিপ্রেশনে ভুগছে। তা হতে পারে না। কেননা ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থায় সে কলমই ধরতে পারবে না। কেননা এ সময় শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, হাত কাঁপবে, চোখে কম দেখতে পারে, নড়াচড়া করার ইচ্ছাও নাও থাকতে পারে।
আমি বলবো, ডিপ্রেশন জীবনের উপলব্ধির ক্ষমতাকে অতল করে দেয়, উপলব্দির ক্ষমতাকে অনেক বাড়িয়ে, জীবনকে দেখার জায়গাটা নানাভাবে পরিবর্তন করে দেয়। তাই সাহিত্যে মন তথা রোগাগ্রস্ত মন বা অসুস্থ মন নিদারুণ কাজ করতে পারে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: হাসান আজিজুল হক, ছোট গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক।