প্রথম সন্তান প্রসব পরবর্তী মায়েরদের মানসিক সমস্যা বেশ সাধারণ একটি বিষয়। প্রথম সন্তান প্রসবের পর শতকারা ৮৫ ভাগ মায়েদেরই বিশেষ কিছু মানসিক সমস্যা হয়। বেশিরভাগ সময়ই এ সমস্যাগুলোকে আমরা উপেক্ষা করে থাকি। অথচ এসব মানসিক সমস্যা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি মানসিক সমস্যাজনিত কারণে মায়ের হাতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে পারে! বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এসব মানসিক সমস্যায় সময়মতো ব্যবস্থা নিলে মা ও শিশুর যেমন তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যগত উন্নতি হয় তেমনি পরবর্তীতে এর অনেক সুফল লাভ করা যায়।
প্রসব পরবর্তী মায়েদের মানসিক সমস্যাগুলো মৃদু থেকে তীব্রতর হতে পারে। তবে সমস্যা যেমনই হোক না কেন তীব্রতার মাত্রাভেদে এসব সমস্যা ভয়াবহতার দিক থেকে কোনটিকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ প্রতিটি মানসিক সমস্যাই মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর ও অস্বস্থিকর। তবে সঠিক ধারণা থাকলে এবং যথা সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে সহজ ও সাবলীলভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব।
সমস্যার স্বরূপ
সন্তান জন্মলাভের কয়েকদিনের মধ্যেই শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মায়েদের কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সামান্য মাথাব্যথা থেকে শুরু করে ঘুমের সমস্যা, খাওয়ার সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, যখন তখন কান্না পাওয়া, অকারণে খুব বেশি খুশি হয়ে যাওয়া, কথা বলতে না চাওয়া, সন্তানের পরিচর্যা না করা, মরে যাওয়ার চিন্তা করা এমনকি বাচ্চাকে মেরে ফেলার চিন্তাসহ অনেক ধরণের মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি কখনও হতাহতের মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
স্থায়িত্ত্ব
সন্তানের জন্মের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাস কিংবা কখনও বছর পর্যন্ত এসব সমস্যা থেকে যেতে পারে। সাধারণত দেখা যায় সমস্যাগুলোকে আমলে না আনার কারণে এসব সমস্যার স্থায়িত্ত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়। এবং যথা সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে এসব সমস্যার স্থায়িত্ত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব।
সমস্যার ধরণ
এক সময় ধারণা করা হতো সন্তান প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যাগুলো এমন কিছু সমস্যা যা গর্ভধারণ ও শিশু জন্মের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে সমস্যাগুলোর প্রকৃতি ও ধরণ অন্যান্য মানসিক রোগের মতোই। অর্থাৎ অন্যান্য মানসিক রোগের যেসব উপসর্গ থাকে এক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম উপসর্গ দেখা যায়। যার কারণে এসব সমস্যাকে অন্য কোন মানসিক রোগ হিসেবে না দেখে মূল মানসিক রোগের চিকিৎসাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।
সন্তান জন্মদান পরবর্তী মানসিক সমস্যাগুলোকে মোটামুটি তিন ধরণে ভাগ করা যায়। যেহেতু সমস্যাগুলো সরাসরি সন্তান জন্মদানের সাথে যুক্ত সেহেতু তিনটি প্রকাশ রূপকে তিনটি নাম দিয়ে ব্যাক্ষা করা হয়।
১- মেটার্নিটি ব্লু বা পোস্টপার্টাম ব্লু
২- পিউরপেরাল ডিপ্রেশান বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (পোস্টপার্টাম মুড ডিজঅর্ডারও বলা হয়)
৩- পিউরপেরাল সাইকোসিস বা পোস্টপার্টাম সাইকোসিস
উল্লেখ্য এই তিন ধরণের সমস্যা একে অপরের চাইতে ভিন্ন।
কারণ
গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ার সাথে বেশকিছু হরমোন সরাসরি জড়িত থাকে। ধারণা করা হয় যে হরমোনের বিভিন্ন তারতম্যের কারণে এসব সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। তবে এ ধারণ বৈজ্ঞানিকভাবে পুরোপুরি সিদ্ধ নয়। তার চাইতে যাদের আগে কোন মানসিক সমস্যা ছিলো তার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টাই বেশি করা হয়। এছাড়া সন্তান জন্মের পর সন্তানের পরিচর্যা করা, অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম ঘুম বা অতিরিক্ত চিন্তাকে এসব সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। মোটকথা হলো এসব মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন বিষয়কে সরাসরি দায়ি করা না হলেও যেহেতু সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন একটি জটিল প্রক্রিয়া তাই এই প্রক্রিয়ার কোনকিছুর সাথে এর সম্পর্ক থাকতে পারে।
কারা এসব সমস্যায় আক্রান্ত হয়?
সদ্য ‘মা’ হওয়া যে কেউই এসব মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি প্রথম, দ্বিতীয় যেকোন সন্তান জন্মদান পরবর্তীই এসব সমস্যা হতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ৫০০ জন মায়ের মধ্যে অন্তত একজন এসব সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে। তবে বলা হয়ে থাকে প্রথম সন্তান জন্মদান পরবর্তী এসব মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া উন্নত দেশগুলোর চাইতে উন্নয়নশীল দেশের মায়েদের এসব সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সমস্যার প্রকটতা বিবেচনা করে এটি বলা যায় যে, বাংলাদেশের গড়ে প্রতি ১মি. ৪০সে. সময়ের ব্যবধানে একজন করে মা এসব সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।
চিকিৎসা
তিন প্রকারের সমস্যার মধ্যে ‘মেটার্নিটি ব্লু’ এর স্থায়িত্ত্বকাল সাধারণত এক সপ্তাহ হয়ে থাকে। সন্তান জন্ম দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এসব সমস্যা আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়। যার কারণ এর নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝে নেয়া জরুরি। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার অর্থাৎ পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এবং পোস্টপার্টাম সাইকোসিস-এর যথাযথ চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো রোগ নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নিলে এসব সমস্যা মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোও হয়ে থাকে সাধারণ ডিপ্রেশন ও সাইকোসিসের মতো।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন। আর তা হলো চিকিৎসা বা চিকিৎসা পদ্ধতি কোনটিই যে শিশুটির জন্য ক্ষতিকর বা অস্বস্থিকর অবস্থার কারণ না হয়। প্রয়োজনে শিশুটির সেফটি ও সিকুরিটির ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।