প্যারেনটিং স্টাইল এবং সন্তানের পড়াশুনায় এর প্রভাব

প্যারেনটিং স্টাইল কি?
প্যারেনটিং স্টাইল হলো এমন একটি কৌশল যেটা মা-বাবা তাদের সন্তানের লালন-পালনের সময় প্রয়োগ করেন। প্যারেন্টিং এর ক্ষেত্রে মা-বাবা সন্তানের সাথে কত বেশি সময় পার করছেন তার চেয়ে কিভাবে সময় কাটাচ্ছেন সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আপনি আপনার সন্তানের সাথে একটা বিকেল কাটিয়েছেন কিন্তু আপনি নিজের কাজ করলেও সন্তানের দিকে খেয়াল করছেন না। অথচ আপনার বন্ধু তার সন্তানের সাথে ২০ মিনিট সময় কাটালো এবং ঐ সময়টুকু শুধুমাত্র সন্তানের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন তিনি, এক্ষেত্রে আপনার বন্ধুর কৌশলটি শিশুদের জন্য উপকারি হবে।
।।।।
প্যারেনটিং স্টাইল ও সন্তানের পড়াশুনার ফলাফলঃ  
মা-বাবা’র প্যারেনটিং স্টাইল সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। বলা হয়ে থাকে পরিবার হল শিশুদের প্রথম স্কুল এবং মা-বাবা হলেন সন্তানের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সবচেয়ে শক্তিশালী আদর্শ।
।।
প্যারেনটিং স্টাইল ধারণাটি স্থান, কাল, পাত্রভেদে আপেক্ষিক একটি বিষয়। সময় ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের সাথে সাথে প্যারেন্টিং স্টাইলেও বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার তৈরি হওয়া, ব্যক্তির কর্মজীবন, অর্থনীতি সর্বোপরি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এ পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত করে।
।।
প্যারেন্টিং স্টাইল এর সাথে সন্তানের পড়ালেখার ফলাফলের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরে নানা গবেষণা করেছেন। গবেষণার ফলাফল জানার আগে চলুন আমরা প্যারেন্টিং স্টাইলের ধরণ গুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেইঃ
।।
প্যারেন্টিং স্টাইল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন (Diana Baumrind) । তিনি প্যারেন্টিং স্টাইল কে ৪ টি ভাগে ভাগ করেছেন।
।।
Authoritarian Parents: এসব মা-বাবারা সন্তানের কাছে বড় কিছু আশা করলেও তাদের প্রতি কম সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তারা সন্তানের কাছ থেকে বিনা শর্তে আনুগত্য পেতে পছন্দ করেন। সন্তানেরা কোন ব্যাখ্যা চাওয়া ছাড়াই তাদের আদেশ মেনে চলবে এমনটাই ধারণা তাদের। এসব মা-বাবা একগুয়ে ধরনের হন এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করেন। তাদের কিছু শক্ত নিয়ম কানুন থাকে এবং তাদের মতের সাথে দ্বিমত হওয়া তারা মোটেও পছন্দ করেন না।
।।
Authoritrative Parents: এটি এমন একটি প্যারেন্টিং স্টাইল যা যুক্তিপূর্ণ, পরিমিত নিয়ম ও নির্দেশনা ঠিক করে দেয়। যেখানে সন্তানের চিন্তা-ভাবনা, আচরণকে গুরুত্ব সহকারে বোঝার চেষ্টা করা হয়। এখানে সন্তানের জন্য নিয়ম-কানুনগুলো পরিষ্কার করে দেখানো হয়। এই স্টাইলটি সন্তান লালন-পালনের জন্য সর্বোত্তম, এসব মা-বাবার সন্তানেরা  গ্রহণযোগ্যভাবে আচরণ করতে শেখে।
।।
এধরনের মা-বাবা সন্তানের কাছে বিভিন্ন প্রত্যাশা করেন আবার সন্তানের  প্রতিও সহানুভূতিশীল। সন্তানের দায়িত্ব কি হবে, কিভাবে সমাজে চলাফেরা করবে তা পরিষ্কারভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেন এসব মা-বাবা। তারা সন্তানের উপর কড়াকড়ি আরোপ পছন্দ করেন না বরং সন্তানের প্রতি অ্যাসারটিভ হন এবং আশা করেন তাদের সন্তানও অ্যাসারটিভ হোক, দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হোক।
।।
তারা চান তাদের সন্তান আত্মনিয়ন্ত্রিত হবে এবং অন্যের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করবে। সন্তান বড় হতে থাকলে এসব মা-বাবা তাদের সন্তানের কাছে বিভিন্ন বিষয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেন।
।।
Permissive Parents: এধরণের  মা-বাবাকে প্রশ্রয়দানকারী মা-বাবা বলা হয়। তারা সন্তানের প্রতি অতি সহানুভূতিশীল হন এবং তার কাছে চাওয়া পাওয়া কম থাকে। এসব মা-বাবা নরম  প্রকৃতির অর্থাৎ গতানুগতিক মা-বাবা থেকে আলাদা, এরা সন্তানের উপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেন না। তারা সন্তানকে যে নির্দেশনা দেন সেগুলো প্রায় অসামজ্ঞস্যপূর্ণ হয়ে থাকে।
।।
Uninvolved Parents: এই শ্রেণীর মা-বাবা সন্তানের প্রতি কম সহানুভূতিশীল এবং তাদের উপর প্রত্যাশাও কম তাকে। সন্তানের উপর কোন আবেগীয় বন্ধন থাকে না বরং ছেলে-মেয়ে অবজ্ঞা, অবহেলার মধ্যে মানুষ হতে থাকে। সন্তানকে শুধু খাদ্য,বস্ত্র, আশ্রয় দেওয়াই তাদের দায়িত্ব বলে মনে করেন বলে তাদের উপর আগ্রহও কম থাকে। এসব মা-বাবার সন্তান প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়।
।।
প্যারেন্টিং স্টাইল ও সন্তানের আচরণ নিয়ে অতীতে অনেক গবেষণা হয়েছে বর্তমানেও হচ্ছে। সন্তানের স্কুলের ফলাফলের সাথে প্যারেন্টিং স্টাইলের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে সম্প্রতি ভারতের নাগপুরে ২০১৩ সালে Monika Seth  Kala Ghormode নামে দুজন গবেষক Authoritative প্যারেন্টিং স্টাইলের সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য লাভের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করেছেন।
।।
Monika Seth  Kala Ghormode শিক্ষাগত সাফল্য পরিমাপ করতে  বিজ্ঞান, অংক, ভাষাশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর কে মূল্যায়ন করেছিলেন। ভারতের ২০ টি স্কুলের ১০০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর উপর গবেষণাটি করা হয় যেখান থেকে ২৫৬ জন কে বাছাই করা হয় যাদের প্যারেন্টিং স্টাইল ছিল Authoritative। প্যারেন্টিং স্টাইল নির্ধারণ করা হয়েছিল সন্তানের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে, মা-বাবার কাছ থেকে কোন উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়নি।
।।
এই ২০ টি স্কুলের মধ্যে ১০ টি ছিল শহরের ও বাকি ১০ টি ছিল গ্রামের । নমুনার মধ্যে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত ছিল সমান। প্যারেন্টিং স্টাইল নির্ধারণ করার জন্য Childrens Perception of Parenting Scale ব্যবহার করা হয়েছিল যেটা Dr. Anand Pyari ও তার সহকর্মীরা ১৯৯৫ সালে তৈরি করেছিলেন । গবেষণাটি এই অনুমান থেকে করা হয়েছিল যে, অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্সের সাথে কোন নির্দিষ্ট প্যারেন্টিং স্টাইলের সম্পর্ক থাকতে পারে।
 ।।
ফলাফলে দেখা গিয়েছিল যে, Authoritative প্যারেন্টিং স্টাইলের সাথে স্কুলের ভালো ফলাফলের উচ্চ সহসম্পর্ক বিদ্যমান। ভাষা শিক্ষার সাথে Authoritative প্যারেন্টিং স্টাইলের সহসম্পর্ক ছিল ০. ৭৭; বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে ০. ৭১; গণিতের সাথে ০.৬৬ । এই গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে যে, মা-বাবার প্যারেন্টিং স্টাইল যত বেশি Authoritative হবে ছেলে-মেয়ের অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্স তত ভালো হবে।
।।
অন্যান্য গবেষণায় প্যারেন্টিং স্টাইল এর সাথে অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্সের সম্পর্ক দেখা যায়। যেমনঃ  Awujo নামে একজন গবেষক তার গবেষণায় দেখেছিলেন যে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনা সম্পর্কিত বিভিন্ন অভ্যাসের সাথে বিভিন্ন ধরণের প্যারেন্টিং স্টাইল সম্পর্কিত। Kingsley Nyarko তার গবেষণায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ফলাফলের সাথে Authoritative প্যারেন্টিং স্টাইল এর ধনাত্বক সহসম্পর্ক খুজে পেয়েছিলেন।Abdorreza Kordi তার গবেষণায় প্রায় একই ধরনের ফলাফল খুঁজে পেয়েছিলেন।
।।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ শিক্ষিত মা-বাবা দু’জনই কর্মজীবী। কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের যে, সন্তানের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে পারেন না তারা। আবার কোয়ালিটি টাইম কাটানো বিষয়টির সাথেও অনেক মা-বা পরিচিত নন। যেহেতু মা-বাবা তাদের সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না, তাই বেশির ভাগ সময় দেখা যায় তারা সন্তানের অতি আবদারগুলো পূরণ করার চেষ্টা করেন। তারা সন্তানকে খেলনা কিনে দিলেও তার সাথে একটু খেলার সময় তারা বের করতে পারেন না।
।।
এভাবে সন্তান যেহেতু যা চাচ্ছে তাই পাচ্ছে তাই তারা ধীরে ধীরে তারা আরো বেশি আশাবাদী হয়। যেহেতু মা-বাবা তাদের সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না সেজন্য তাদের সন্তানের চাহিদা খুব দ্রুত পূরণ করার চেষ্টা করেন। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের চাহিদা আরো বাড়তে থাকে।  একসময় মা-বাবা সন্তানের এই অপরিসীম চাহিদা আর পূরণ করতে পারেন না, তখন সন্তান রাগারাগি সহ নানা ধরণের খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। তাদের প্রত্যেক মা-বাবার উচিত তাদের সন্তানের চাহিদাগুলো খুব সচেতনভাবে পূরণ করা।
।।
এছাড়া, প্রতিদিন গড়ে সন্তানের সাথে ৩০ মিনিট সময় কাটানো দরকার মা-বাবার। আর ঐ সময়টা শুধুমাত্র সন্তানের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত।
।।
Previous articleপ্যানিক ডিজঅর্ডার: ভয় এড়িয়ে মানসিক রোগ থেকে বাঁচুন
Next articleহস্তমৈথুন নয়, পারফরম্যান্স এংজাইটিই সেক্সের জন্য ক্ষতিকর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here