প্যারেনটিং স্টাইল এবং সন্তানের সহিংস আচরণ

আজকাল খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে হত্যা, ধর্ষণ, মারামারি, সহিংসতার খবর। যা বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, এসব সহিংস ঘটনার একটা বেশ বড় অংশ সংঘটিত হচ্ছে কিশোর ও যুবকদের দ্বারা।

এসব আগ্রাসনের জন্য বিভিন্ন বিষয় দায়ী। দায়ী এসব উপাদানগুলোর মধ্যে প্যারেন্টিং স্টাইল একটি। বাবা-মা কিরূপ প্যারেন্টিং স্টাইল অনুসরণ করছেন তার উপরও সন্তানের আক্রমণাত্মক আচরণ বিকাশ লাভ করতে পারে। পিতামাতার প্যারেন্টিং স্টাইলের সাথে সন্তানের আক্রমণাত্মক আচরণ করার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আসছেন। শৈশবকাল এমন একটি সময় যখন তাদেরকে নানা ধরনের চালেঞ্জ ও চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এসময়টাতে টিনএজরা বা কিশোররা বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সাধারণত বেশ কিছু কারণে কিশোর ও যুবকরা আক্রমণাত্নক আচরণ করে। যেমনঃ তাদের নানা ধরনের শারীরিক পরিবর্তন, হরমোনের পরিবর্তন, স্বাধীনতা লাভের বাসনা, নতুন পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করা, তাদের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হওয়া ইত্যাদি।

কিশোর ও যুবকদের সামাজিক সম্পর্ক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ তদারকি করার ব্যাপারে পিতামাতা খুব বড় ভূমিকা পালন করেন। কিশোরদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা যেতে পারে এবং তারা কিশোর অপরাধী হয়ে উঠতে পারে (Patterson, 1984)। Collins and Laursen ১৯৯৯ সালে গবেষণায় দেখেন যে, শিশুরা কি শিখবে, একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করবে তা পিতামাতার সাথে তাদের সম্পর্ক, প্যারেন্টিং স্টাইল এবং পিতামাতার আচরণের উপর নির্ভর করে।

বান্ডুরা তার সামাজিক শিক্ষণ তত্ত্বে বলেছেন অনুকরণ এর মাধ্যমে শিশু কিশোররা তাদের মডেলের কাছ থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ শিখে থাকে। এছাড়া অন্যদের আক্রমণাত্মক আচরণ করে লাভবান হতে দেখেও শিশু কিশোররা আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় Vicarious learning। সন্তান যখন দেখে তার পিতা বা মাতা আক্রমণাত্মক আচরণ করে বা রাগ দেখিয়ে কোনো কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে তখন সন্তানরাও তাদের পিতামাতার দেখাদেখি একই প্রক্রিয়ায় পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আবার ছোট বয়সে কেউ যদি রাগী স্বভাবের হয় তখন অনেক পিতা মাতা দেখা যায় প্রশংসার সুরে বলে থাকেন যে আমার ছেলে বা মেয়েটি খুব রাগী স্বভাবের হয়েছে। এটা তার জন্য একধরনের পুরস্কার হিসেবে কাজ করে এবং তার আচরণটি বজায় থাকে।

Authoritative প্যারেন্টিং হল বিভিন্ন প্রকার প্যারেন্টিং স্টাইলের মধ্যে সবোৎকৃষ্ট স্টাইল। কারণ এখানে সন্তানকে পরিমিত নিয়ন্ত্রণ করা হয়; সাথে সাথে সন্তানের সাথে একটা উষ্ন আবেগীয় সম্পর্ক থাকে। অন্যান্য যে প্যারেন্টিং স্টাইল আছে যেমনঃ Permissive, Indulgent, Neglectful ইত্যাদি সবগুলোই সন্তানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কারণ Authoritative প্যারেন্টিং ছাড়া বাকি সবগুলোতে হয় পর্যাপ্ত উষ্ণতার অভাব অথবা পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের অভাব (Iwaniec, 19997)। যেমনঃ Authoritarian প্যারেন্টিং এ অত্যাধিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় কিন্তু উষ্ণতার চরম ঘাটতি দেখা যায়।

Baumrind, (১৯৯১) বিশ্বাস করেন সঠিক প্যারেন্টিং স্টাইল এমন হবে যেখানে সন্তানকে শাস্তি দেওয়া হবে না, আবার তার ব্যাপারে উদাসীনও হওয়া যাবে না। বরং তিনি মনে করেন পিতামাতা সন্তানের জন্য উপযুক্ত বিধি-বিধান, নিয়ম-কানুন ঠিক করবেন এবং তাদের সাথে একটা সুন্দর উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। যেমনটি করা হয় Authoritative প্যারেন্টিং এর ক্ষেত্রে। বামরিন্ড বিশেষত ৩ ধরনের প্যারেন্টিং স্টাইল এর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন যেগুলো কিশোর ও যুবকদের আক্রমণাত্মক আচরণের সাথে সম্পর্কিত। এসব প্যারেন্টিং স্টাইল এর ক্ষেত্রে আবার ‍দুটি দিক বা মাত্রার দিক থেকে আলাদা করা যায়। সে দুটি দিক হল সংবেদনশীলতা বা উষ্ণতা এবং নিয়ন্ত্রণ। Authoritative প্যারেন্টসরা উষ্ণ হন শিশুদের আদর ভালোবাসা ও পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ সহকারে মানুষ করতে সচেষ্ট থাকেন। তারা পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন এবং সন্তানের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। এধরনের পিতামাতার সন্তানেরা আত্মনির্ভরশীল হয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, নিজেদের ঝোঁক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিপরীত দিক থেকে Authoritarian প্যারেন্টিং এর ফলে তাদের সন্তানদের মাঝে অসামাজিক ও আক্রমণাত্মক আচরণ বিকাশ লাভ করতে পারে, সন্তান রাগী স্বভাবের হতে পারে এবং কিশোর ও যুবক বয়সে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায় (Baumrind, 1991)।

Authoritarian পিতামাতারা সন্তানদের উপর কঠিন বিধি-নিষেধ আরোপ করেন, পরিবারে অন্যদের সাথে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করা হয়না বললেই চলে। এরকম আরো নানা কারণে এধরনের পিতামাতার সন্তানদের মাঝে সামাজিক গুণাবলী সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করেনা, তারা তাদের আবেগগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এর ফলে সমাজবিরোধী নানা ধরনের কার্যকলাপ সে করে।

আবার Permissive পিতামাতারা হলেন Authoritarian পিতামাতাদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের। তারা সন্তানের আচরণে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন না, সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন তারা মানতে পারেন না। সন্তানের প্রতি উষ্মতা বা সংবেদনশীলতা উচ্চ হয়। এধরনের পিতামাতর সন্তানেরা কিশোর-যুবক বয়সে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে তারা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে পারে। এসব পিতামাতা তাদের সন্তানের বিষয়ে উষ্ণ, কেয়ারিং হলেও তাদের আচরণের সীমা নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা হিমসিম খান। ফলে সন্তানের মধ্যে বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ তৈরি হয় এবং সেটা বজায় থাকে। এসব সন্তান নিজেদের আবেগকে বা ঝোঁককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার বিকাশ সাধন করতে পারেনা।

বিখ্যাত গবেষক Grafeman ২০০৮ সালে এক গবেষণায় দেখেন যে সন্তানদের শাস্তি দিলে এবং ভালো আচরণের জন্য পুরস্কৃত না করা হলে তাদের মধ্যে আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। আবার Mervielde নামক একজন গবেষক তার গবেষণায় দেখেন যে, ভয়ঙ্কর অপরাধীরা সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে পিতামাতার আদর ভালোবাসা কম পেয়েছে এবং তত্ত্বাবধান কম পেয়েছে। Mccord নামক আরেক গবেষক তার গবেষণায় দেখেছেন পিতামাতা প্রদত্ত শারীরিক ও মানসিক শাস্তি এবং পর্যাপ্ত উষ্ণতার অভাব আক্রমণাত্মক আচরণকে পূর্বানুমান করতে পারে।

প্যাটারসন এবং তার সহযোগীরা একটি গবেষণায় দেখেন যে, কিশোর অপরাধ ও যুবকদের আক্রমণাত্মক আচরণের সাথে পিতামাতা কর্তৃক অতিনিয়ন্ত্রণ ও বিশেষ ধরনের প্যারেন্টিং স্টাইল যেমনঃ Authoritarian প্যারেন্টিং ও Permissive প্যারেন্টিং সম্পর্কযুক্ত।

Coie & Dodge ২০০২ সালে এক গবেষণায় দেখেন যে, নেতিবাচক সামাজিক অভিযোজন যেমনঃ হিংসা, শত্রুতা, নিম্ন-আত্নবিশ্বাস ইত্যাদির সাথে Authoritarian প্যারেন্টিং সম্পর্কিত।

Ladd & Pettit ২০০২ সালে তাদের গবেষনায় দেখেন যে, যেসব পিতামাতা শাস্তি প্রদান করেন, খুব কঠিন, কঠোর নিয়ম-কানুন বেঁধে দেন, সন্তানের ব্যক্তি স্বাধীণতায় বাঁধা দেন, যারা তাদের বিভিন্ন চাহিদার ব্যাখ্যা সন্তানকে দেননা তাদের সন্তানেরা বেশি আক্রমণাত্মক হয়, স্কুলের বন্ধুদের সাথে বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ করে। তাই পিতামাতা হিসেবে আমরা যদি আমাদের সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় খেয়াল রাখি তবে হয়তো সমাজ থেকে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, মারামারি, হিংসা ইত্যাদি অনেকাংশে কমে যাবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআমি ধৈর্য্য ধরে কোনো কাজ করতে পারি না
Next articleআগ্রাসন এবং ক্রীড়ার সম্পর্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here