সমস্যা: পরিবারে মা-বাবার কলহ আর দারিদ্র্যের মাঝেই বড় হয়েছি আমি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মার্স্টার্স শেষ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা করে এখন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি।
প্রায় ১২ বছর ধরে আমার একমাত্র ছোটভাই ঘুমের সমস্যায় ভুগছে। আমার বড় বোনের বছর দুয়েক আগে কিডনি দুটোই ড্যামেজ হয়। পরে মারা যায়। বোন মারা যাওয়ার দশ-পনেরো দিন আগে হঠাৎ দেখি আমার ঘুম হচ্ছে না। মাথা কান সবসময় গরম থাকে, অস্থিরতা, শরীর দুর্বল, ঘুম না হওয়া, মৃত্যুভয়, চেহারা দিনদিন খারাপ হয়ে যাওয়া, টেনশন, দুঃশ্চিন্তা লেগেই ছিল। মনে হতো আমিও মরে যাব।
এভাবে টানা কয়েকদিন চলার পর আমি পিজিতে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দেখাই। তিনি আমাকে রিভোট্রিল ০.৫ এমজি ও প্যানটোনিক্স ২০ এমজি খেতে দেন। ১০ দিন খাওয়ার পর অবস্থার উন্নতি না হলে আমি পিজি হাসপাতালের মনোরোগ বহিঃবিভাগে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাই। তিনি আমাকে মিটাপ্রেক্স ১৫ এমজি ও রিভোট্রিল ০.৫ এমজি খেতে দেন। মাস দেড়েক খাওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল।
পরে একই বিভাগে আবারো দেখালে আরেক চিকিৎসক আমাকে ট্যাবলেট এমিলিন ১০ এমজি ও ইনডেভার ১০ এমজি খেতে দেন। তাতে কিছু সমস্যা আরো বেড়েই যাচ্ছিল বুঝে আমি বেসরকারি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলে তিনি আমাকে পেইস ০.৫ ও ভিটামিন বি খেতে দেন।
আমি প্রায় মাস দুয়েক খেয়েছি। এতে অবস্থার সাময়িক উন্নতি হলেও পুরোপুরি হয়নি। ওষুধ খেলে ঘুম হতো কিন্তু না খেলে ঘুম হতো না। আর ঘুম হলেও কোনো তৃপ্তি পেতাম না। পরে ডাক্তারি চিকিৎসা বাদ দিয়ে হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করি। এতে ঘুম হয়, অনেকটা পরিতৃপ্তিও পাই।
প্রায় চার মাস ধরে হোমিও চিকিৎসা নিচ্ছি। আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হলেও পুরোপুরি সমাধান হয়নি। এ নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে আমি এসব সমস্যায় ভুগছি।
আমি কি ডিপ্রেশনে ভুগছি? আমার কি করা দরকার? মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হলে কোথায় যাব? অনেকে বলছে বিয়ে করলে এসব ঠিক হয়ে যাবে? পরামর্শ দিলে উপকৃত হব। উল্লেখ্য আমি কিছুদিন আগে মেডিটেশন এর কোর্সও করেছি, নিয়মিত ব্যায়ামও করি।
পরামর্শ: প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি লিখেছেন ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার কলহ এবং দারিদ্র্যের মাঝেই বড় হয়েছেন। দুটি সমস্যাই ব্যক্তিত্বের গঠন প্রণালীতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যার কারণে সমস্যা দুটি আপনার মনে দাগ কেটেছে।
কিন্তু ভালো দিক হলো আপনার মেধা এবং উদ্বিগ্নতা থাকার কারণেই আপনার চারিত্রিক গঠনে একটা পজেটিভ দিকও গড়ে উঠেছে। যা আপনাকে বাস্তব জীবনে উন্নতি সাধনে সহায়তা করেছে। আপনার ছোট ভাইয়ের অসুখ এবং বোনের কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু আপনার মাঝে বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা থাকার কারণেই দৈহিক উপসর্গের মাধ্যমে তার প্রকাশ পেয়েছিল। এই কারণেই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আপনি সঠিকভাবেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আপনি জানতে চেয়েছেন আপনার মাঝে বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা আছে কিনা।
সাধারণত বিষণ্নতা এবং উদ্বিগ্নতা প্রায়ই একসাথে চলে এবং শারীরিক উপসর্গের মাধ্যমেই তা প্রকাশ পায়। যারা আপনাকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা উদ্বিগ্নতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আমার ধারণা যথেষ্ট মাত্রায় এন্টিডিপ্রেশেন্ট এবং এনজিওলাইটিক ড্রাগস একটু বেশি মাত্রায় কিছুদিন (কমপক্ষে ৩ মাসের মতো) খেলে উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
যদিও আপনার সাথে আমার সাক্ষাত হয়নি তাই এর বেশি বলা ঠিক হবে না। আপনি চার মাস যাবৎ হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে ভালো আছেন জেনে খুশি হলাম। হোমিওপ্যাথি সন্মন্ধে যেহেতু আমার জ্ঞান সীমিত এ কারণেই এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
তবে এই মুহুর্তে আমার এক জার্মান বন্ধুর কথা মনে পড়লো। তিনি বলেছিলেন, আমরা জার্মানরা তিনটি জিনিসের আবিষ্কারক- কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্র, ফ্রয়েডের সাইকো এনালাইসিস এবং হানিম্যানের হোমিওপ্যাথিক। এই তিনটি মতবাদই আমরা প্রায় বাদ দিয়েছি।
আপনি জানতে চেয়েছেন কোথায় চিকিৎসা নেবেন। আমার মনে হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে গেলে বিএসএমএমইউ অথবা এনআইএমএইচ (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট)-এ চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে ওষুধের সাথে সাপোর্টিভ সাইকোথেরাপি (বিশেষ করে রিলাক্সেশন থেরাপি) আপনার চিকিৎসায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আপনাকে উপদেশ দিয়েছেন আপনি বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি মনে করি বিয়েটাকে চিকিৎসা হিসেবে না নিয়ে জীবনের একটি প্রয়োজনীয় দিক হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। আপনার মত সংবেদনশীল ও নিখুঁত প্রকৃতির মানুষের জন্য সম্ভব হলে কিছুটা জানাশুনার মাধ্যমে। বিশেষ করে একজন আরেকজনের মন-মানসিকতার ও গুণাবলি ও সীমাবদ্ধতা সন্মন্ধে জানাশোনার পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আর যদি তা সম্ভব না হয়, বিয়ে জীবনের একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে দায়িত্বের সাথে অগ্রসর হওয়া উচিত। আমি আশা করব আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং জীবনে সুখী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
পরামর্শ দিয়েছেন:
প্রফেসর ডা. হেদায়েতুল ইসলাম