বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে আজ সারা বিশ্বের মানুষ গৃহবন্দী জীবন যাপন করছে। স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সবার মন মানসিকতার উপর এর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে সেটি এখন বেশ স্পষ্ট। অন্যান্য সমস্যার মত দাম্পত্য কলহ বৃদ্ধি এগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে আজ আমরা আলোচনা করব।
১) অন্তর্মুখী-বহির্মুখী মানসিকতার মিশেলঃ যখন একজন অন্তর্মুখী মানুষ এবং একজন বহির্মুখী প্রবণতার বিপরীত ধর্মী মানুষ একসাথে ঘর বাধে, দুজনকে অনেক বিষয় মানিয়ে নিয়েই একে অপরের সাথে থাকতে হয়। কিন্তু এই অস্বাভাবিক অবস্থায় যখন গৃহবন্দী জীবন অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন সেই ব্যাল্যান্স ঠিক রাখা সব সময় সম্ভব হয়ে উঠছেনা হয়তো। যারা বেশ মিশুক প্রকৃতির এবং বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে যেতে বা আড্ডা দিতে পছন্দ করে তারা এই গৃহবন্দী জীবনে বেশ অসুবিধায় পড়েছেন। করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয় যেমন মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে তেমনি এই গৃহবন্দী জীবনও মানসিক দিক থেকে তাদের বেশ চাপের মুখে ফেলছে। অনেকের ক্ষেত্রেই এই চাপ ক্রোধ বা বিরক্তি হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। আবার যারা একটু একা থাকতে ভালবসেন, একটু কম কথা বলেন বা একটু কম মিশুক তাদের জন্যও এই গৃহবন্দী জীবন যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদেরকে মোটেও সময় দিতে পারছে না এবং এতে তাদের মাঝেও বিরক্তি এবং হতাশার জন্ম দিচ্ছে। সর্বোপরি এ সকল কারণে, এই গৃবন্দী অবস্থায় যখন এই দুই প্রকৃতির মানুষ একই ছাঁদের তলায় বসবাস করছেন, তখন তাদের মাঝে স্বভাবতই কলহ সৃষ্টি হচ্ছে।
২) অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তাঃ কেউ জানেনা বৈশ্বিক এই মহামারী কবে শেষ হবে। অনেকেই কর্মহীন হয়ে দিনের পর দিন গৃহবন্দী জীবন যাপন করছে যা তাদের জন্য অনেক বড় দুশ্চিন্তার কারণ। তারা জানেনা অনাগত ভবিষ্যৎ তাদের জন্য কি নিয়ে আসবে বা এই মহামারীর সময়টা তারা কিভাবে কোন কাজ ছাড়া পার করবেন। এসব চিন্তা মনকে আরও বিচলিত করে দিচ্ছে এবং তারা গভীর উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছেন। এসব কারণ তাদের দাম্পত্য জীবনেও প্রভাব ফেলছে।
৩) ধৈর্যের ঘাটতিঃ অনেকের মাঝেই ধৈর্য অত্যন্ত কম। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানসিক সন্তুলান হারিয়ে অনেকেই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে গৃহবন্দী থাকার এই বাড়তি চাপ অনেকেই নিতে পারছেনা। তাই অকারণেই অনেকে খুব সামান্য বিষয়েও হয়তো অনেক বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলছে যা দাম্পত্য কলহে রূপ নিচ্ছে।
৪) সন্তান লালন-পালনঃ যেহেতু স্কুল বন্ধ সেহেতু বাবা-মায়ের উপর বাড়তি চাপ হিসেবে রয়েছে সারা দিন অন্যান্য কাজের সাথে সন্তানদের সামলানোর ঝক্কি। তাদেরকে সারা দিন সন্তানদের পড়াশুনা, খেলাধুলা, খাওয়াদাওয়া, দেখাশোনা সব নিজেদেরকেই দেখতে হচ্ছে। তাদেরকে অনেক বেশী সময় দিতে হচ্ছে। এসব বিষয় তাদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অতিরিক্ত চাপের কারণেও অনেক সময় দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হচ্ছে।
৫) মৃত্যু ভয়ঃ সব সময় আমাদের মনে এই ভয় কাজ করছে যে আমরাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি এবং হয়তো আমরাও হতে পারি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া মানুষদের এক জন। এই উদ্বিগ্নতা সারাক্ষণ আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এ কারণে আমরা যেভাবে আমাদের সঙ্গীর সাথে মিশে থাকতে চাই ঠিক সেভাবে হয়তো সামাঞ্জস্য বিধান করে চলা সম্ভব হচ্ছেনা। এতে অকারণ কলহের সূত্রপাত হচ্ছে।
৬) উদ্বিগ্নতাঃ এখন পর্যন্ত এই মহামারীর কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দিন দিন মৃত্যু মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চিকিৎসার অভাবে চোখের সাম্নেই এত মানুষ মৃত্যু বরণ করছে এটি মেনে নেওয়া প্রকৃতপক্ষে খুবই কঠিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা সবাইই খুব অসহায়। এই অসহায়ত্ব আমাদের উদ্বিগ্ন ও বিষাদগ্রস্ত করছে প্রতি মুহূর্তে। এই উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা থেকেও দাম্পত্য জীবনে অশান্তি তৈরি হচ্ছে।
মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এর ফলে আমাদের শুধু দাম্পত্য জীবনে নয়, বরং সামাজিক জীবনেও বিভিন্ন চ্যালঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।