শিশু-কিশোরদের কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বড়দের তুলনায় কম এ কথা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কম হলেও এ বৈশ্বিক মহামারীতে শিশু-কিশোররা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি অন্যান্য রোগেও এ সময়ে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা।
শারীরিক ও মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ স্বাভাবিক শিশু-কিশোরদের তুলনায় অটিজম ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের অনেকটাই ভিন্ন। সাধারণ শিশু-কিশোররা তাদের সমস্যার কথাগুলো স্বজনদের বলতে পারে, বুঝাতে পারে কিন্তু এ বিশেষ শিশুরা তাদের কথাগুলো স্বজনদের বলতে পারে না আবার কোনো ভাবে বুঝাতেও পারে না। ফলে যখন রোগের উপসর্গগুলোর মাত্রা প্রকট অবস্থা ধারণ করে তখন বিশেষ শিশুদের অভিভাবকরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
এ বৈশ্বিক মহামারীতে দীর্ঘসময় শিশু-কিশোররা ঘরবন্দি থাকায় বন্ধুবান্ধব ছাড়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এতে তারা বাবা-মা বা পরিবারের অন্যদের বেশি কাছে পেতে চায় কিন্তু কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের তথা বিশেষ শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। এতে তাদের অসহায়ত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাই মা বাবাকে বিষয়টি বিশেষভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টির ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
দীর্ঘসময় ধরে শিশুর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু একদিকে শিক্ষাগত দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে তার সকালের সময় অর্থবহভাবে কাটাতে না পারায় তারা শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘসময় ধরে টিভি, মোবাইল ব্যবহারে শিশুদের শারীরিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ওবেসিটিতে (স্থুলকায় শিশু) রূপ নিচ্ছে। শিশুর ওবেসিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অনেক জটিল রোগ হয়ে থাকে যা এখন পরিলক্ষিত না হলেও পরবর্তীতে তার প্রভাব পড়তে পারে। সেদিকে বাবা-মাকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অনেক শিশুর পিতা-মাতা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। আর্থিক সংকটের কারণে অভিভাবকদের মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করছেন বা করতে পারেন। অভিভাবকদের এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, তার ছোট শিশুটি কোনোভাবেই যেন তার আচরণে কষ্ট না পায়। অভিভাবকদের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে শিশু-কিশোরদের মানসিক সংকট বেড়ে যেতে পারে।
করোনা সংক্রমণের মধ্যে অনেক অভিভাবক তাদের প্রয়োজনে বাইরে বের হলে ঝুঁকির কথা ভেবে তাদের সন্তানদের ঘরেই রাখছেন। বেশিরভাগ সময় শিশু বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না এবং খেলাধুলা করতে পারছে না। নিঃসঙ্গতার কারণে এ সময় অনেক শিশু-কিশোরদের মধ্যে আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। অনেক সময়ই তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তারা বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য হচ্ছে। শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা পড়ছে। বিশেষ শিশুদের হাইপার অ্যাকটিভিটি (অতি চঞ্চলতা) আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এ সময়ে শিশুর মানসিক দিকটি বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হবে।
ভয়ংকর এ ব্যাধির কারণে আমাদের চারপাশে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে তার জন্য কেউ আগেভাগে প্রস্তুত ছিল না। আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক সব ক্ষেত্রেই আমাদের নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে সন্তানের ওপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যাতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব না পড়ে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব সংকটের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক ঘটনাকালে যদি অভিভাবকরা সতর্ক না থাকে তাহলে শিশু-কিশোরকে দীর্ঘমেয়াদে কোনো কুফল বয়ে আনতে পারে। তাই এ সময়ে পরিবারকেই সব চেয়ে বেশি সর্তক থাকতে হবে।
করোনাকালীন সংকটে সাধারণ শিশু-কিশোরদের ওপর যতটা নজর দিতে হবে তার চেয়ে অনেক বেশি নজর দিতে হবে বিশেষ শিশুর ওপর। এদের অনেকে সব কিছু বুঝতে পারলেও কথা বলতে পারে না। মনে রাখতে হবে খারাপ ব্যবহার করে উত্তেজিত হয়ে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। পরিবারের লোকজনকেই শিশু-কিশোরের সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানে নজর দিতে হবে।
বর্তমানে কোভিডকালীন এ পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের ধীরে ধীরে অবহিত করতে হবে। পরিস্থিতি সঙ্গে মানিয়ে চলতে তাদের ধৈর্য ধরে বোঝাতে হবে। পড়ালেখায় তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। তাদের শারিরিক ও মানসিক শক্তি বাড়াতে শিক্ষণীয় কথা বলতে হবে। বিনোদন হয় এমন ঘরোয়া খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাঝে মাঝে খোলা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি আপনার সন্তানের অর্থবহ সময় কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি একা নয়, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। সবাইকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাই করোনা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা ধরে নিয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের যত্ন নিতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়