গত ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হলো বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রেক্ষাপট কেমন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কী কী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে কী কী পরিকল্পনা নেয়া হবে এসব নিয়ে মনেরখবর প্রতিনিধির সাথে কথা বলেন ‘সোস্যাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন বাংলাদেশ’ (এসএসপিবি)-এর সভাপতি ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী।
স্যার, আত্মহত্যার বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটটা কেমন?
আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটটা এমন যে এখানে এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয় না তারমধ্যে আত্মহত্যার বিষয়টি বেশ স্পর্ষকাতর একটি বিষয়, বিশেষ করে এদেশের জন্য। এখানে আত্মহত্যা বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে লুকানোর একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আপনাদের কোনো কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে কি?
আশার কথা হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি ইনস্টিটিউট করার প্রস্তাব করেছিলেন। যখন আমি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলাম তখন চিঠিটি আমার কাছে এসেছিল এবং সেই চিঠির প্রেক্ষিতে একটি প্রতিবেদন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর দাখিল করি। যেহেতু আমি এখন সরকারী চাকুরিতে নেই সেহেতু তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমার জানা নেই।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরির কোনো পরিকল্পনা?
আত্মহত্যার ব্যাপারে সচেতনতা আগের চাইতে এখন অনেক বেশি। এবং এই সচেতনতা তৈরি হয়েছে মূলত মিডিয়ার কল্যাণে। এখানে আমাদেরও কিছু কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে তবে যেহেতু আমাদের এই আত্মহত্যা প্রতিরোধ সোসাইটির বয়স মাত্র এক বছর তাই এখনও মাঠ পর্যায়ের কাজে আমরা নামতে পারিনি।
[int-quote] বাংলাদেশের মেয়েদের বেশি আত্মহত্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ বিষণ্ণতা। কারণ এমনিতেই মেয়েদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার বেশি। আবার এদেশের মেয়েদের মধ্যে একটা নিরবতার ভাব লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ অবশ্য রয়েছে, এদেশের নারীরা এখনও সেভাবে অগ্রসর হয়নি যে নিজের সমস্যা নিজে বলবে বা নিজেই বিশেষজ্ঞের শ্মরণাপন্ন হবে। একদিকে মেয়েরা ঘর সামলায়, রান্নাবান্না করে। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে ব্যাপারটি সহজ মনে হলেও কাজগুলো ভীষণ জটিল, এই একই ধরনের জটিল কাজ নিয়মিত করতে করতে তারা এক সময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। আবার আরেকদিকে সন্তান ধারণ এবং সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্নতা প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু একজন গর্ভধারীনীর যে মানসিক যত্নের প্রয়োজন সে ব্যাপারটি আমরা গুরুত্বের সাথে নেই না বা অনেক ক্ষেত্রে জানি না।[/int-quote]
আত্মহত্যা বিষয়ক প্রচারণায় মিডিয়ার অনেক দূর্বলতাও রয়েছে। বিশেষকরে এদেশের গণমাধ্যম কর্মীগণ আত্মহত্যায় মিডিয়ার ভূমিকা বিষয়ে যেসব গবেষণা রয়েছে সেটি তারা কীভাবে পেতে বা জানতে পারেন?
এইযে মাঠ পর্যায়ে আমাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা তার একটি হচ্ছে এলাকার যারা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যেমন স্থানীয় চেয়ারম্যান মসজিদের ইমাম অর্থাৎ যাদের কথা মানুষ শোনে তাদের ট্রেনিং দেয়া এবং একই সাথে মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তাদেরও এই ট্রেনিং-এর সাথে সংযুক্ত করা।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার কেমন?
পুলিশ রেকর্ড এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেব অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এবং ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এর ২৫ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আগেই বলেছি আত্মহত্যা নিয়ে এদেশে লুকোচুরির একটা ব্যাপার আছে তাই আমার ধারণা এই হার আরো অনেক বেশি হবে।
প্রতিটা আত্মহত্যাই ভিন্ন তবুও কিছু কমন ফ্যাক্টর থাকে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এই কমন ফ্যাক্টরগুলো কি?
এদেশে আত্মহত্যার জন্য সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে যশোর ঝিনাইদহ এলাকা। এখানকার একটা ব্যাপার হলো এ অঞ্চল বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো নয়। দেশের অন্যান্য স্থানের মানুষদের যেভাবে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় যেমন নদী ভাঙ্গন জলোচ্ছাস অথবা উত্তরবঙ্গে খরা। কিন্তু যশোর ঝিনাইদহ অঞ্চলে এমন সমস্যা কম বা তাদের প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে হয় কম। এই যে টিকে থাকার যুদ্ধ এটা তাদের সেভাবে করতে হয় না বলে ছোটখাটো সমস্যাতেই তারা অনেক বেশি আবেগি হয়ে উঠে। তাছাড়া সারা দেশের ক্ষেত্রে অভাব, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব, বৈষম্য, যৌতুক, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি বিষয়গুলো আত্মহত্যার একটি বড় কারণ।
আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা আত্মহত্যার হারকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছেনা কি?
হ্যাঁ, আত্মহত্যার সামগ্রিক বিষয়টি আমরা যদি পর্যালোচনা করতে যাই তাহলে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি উঠে আসে তা হলো আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা। তারমধ্যে কীটনাশক অন্যতম। একদিকে কৃষকের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়ই, কিন্তু ব্যবহারের পর তারা সেটিকে সেভাবে একটি নিরাপদ স্থানে রাখতে পারে না। আরেকটি হলো বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ। ঘুমের ওষুধগুলো সেভাবে মৃত্যুর কারণ হয় না, তবে একবার দুইবার তিনবার অনেকগুলো করে ঘুমের ওষুধ খেলে সেটি শরীরে স্থায়ী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
এগুলো নিয়ন্ত্রণের কোনো পরিকল্পনা বা নীতিমালার প্রস্তাব সরকারকে করেছেন কি?
ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারের তো আগে থেকেই নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু দেশের অধিক জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে সরকারে লোকবল সংকটের কারণে সে নীতিমালার প্রয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। আর কীটনাশক ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিয়ে নীতিমালা তৈরি হচ্ছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এমন একটি নীতিমালা তৈরি করা বা তার প্রয়োগটা বেশ দূরহ। কৃষকের কীটনাশক লাগবেই আবার এদেশের কৃষকদের যেখানে নিজেদের থাকার বন্দোবস্তই হয় না সেখানে আলাদাভাবে কীটনাশক রাখার বন্দোবস্তই বা তারা করবে কীভাবে। আসলে এক্ষেত্রে নীতিমালার চাইতে যেটা বেশি জরুরি তা হলো সচেতনতা।
এবারের আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘কানেক্ট কমুউনিকেট কেয়ার’। কাদের সাথে কানেক্ট হয়ে কমিউনিকেট করতে হবে?
অবশ্যই প্রথমে যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে ফিরেছে তারা, তারপর যারা আত্মহত্যা করেছে বা করার চেষ্টা করেছে তাদের পরিবার। এছাড়া কিছু কিছু মানসিক রোগ রয়েছে যেমন বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, এংজাইটি এসব রোগের কারণেও আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশে যতটুকু পরিসংখ্যান রয়েছে তাতে দেখা যায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। সারা বিশ্বে যেখানে বয়ষ্ক এবং পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা যায় সেখানে বাংলাদেশের চিত্র পুরোটাই উল্টো। এর কারণ কী হতে পারে?
হ্যাঁ, মেয়েরা বেশি এবং কমবয়সী মেয়েরা বেশি। ব্যতিক্রম হলেও ব্যাপারটি ব্যাক্ষার যোগ্য। বাংলাদেশের মেয়েদের বেশি আত্মহত্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ বিষণ্ণতা। কারণ এমনিতেই মেয়েদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার বেশি। আবার এদেশের মেয়েদের মধ্যে একটা নিরবতার ভাব লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ অবশ্য রয়েছে, এদেশের নারীরা এখনও সেভাবে অগ্রসর হয়নি যে নিজের সমস্যা নিজে বলবে বা নিজেই বিশেষজ্ঞের শ্মরণাপন্ন হবে। একদিকে মেয়েরা ঘর সামলায়, রান্নাবান্না করে। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে ব্যাপারটি সহজ মনে হলেও কাজগুলো ভীষণ জটিল, এই একই ধরনের জটিল কাজ নিয়মিত করতে করতে তারা এক সময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। আবার আরেকদিকে সন্তান ধারণ এবং সন্তান জন্মদান পরবর্তী বিষণ্নতা প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়ের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু একজন গর্ভধারীনীর যে মানসিক যত্নের প্রয়োজন সে ব্যাপারটি আমরা গুরুত্বের সাথে নেই না বা অনেক ক্ষেত্রে জানি না।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে মনেরখবর পাঠকদের কিছু প্রাথমিক ধারণা দিবেন কি?
আত্মহত্যা মূলত দুই রকমের হয়ে থাকে। প্রথমত কিছু মানুষ হঠাৎ আত্মহত্যা করে, তাদেরকে নজরে রাখা মুশকিল। আরেক প্রকার রয়েছে যারা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করে থাকে। একটু সচেতন হলেই এ ধরনের মানুষদের আত্মহত্যার চেষ্টা রোধ করা সম্ভব। যারা বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া বা এংজাইটির মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত বা যারা দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছে ভাবছে অথবা বলছে জীবনটা তার কাছে বোঝা মনে হয়, তার জন্য অন্যরা কষ্ট পাচ্ছে, অথবা কেউ বলছে তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয় বা আত্মহত্যা করতে চায়। এসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখতে হবে। এবং প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
ধন্যবাদ আপনাকে স্যার
ধন্যবাদ মনেরখবরকেও