হার্ড ইমিউনিটি: কোভিড-১৯ প্রতিরোধে একটি ভয়াবহ ভ্রান্তধারণা

করোনাভাইরাস: হার্ড ইমিউনিটি কতটা কার্যকর?
করোনাভাইরাস: হার্ড ইমিউনিটি কতটা কার্যকর?

নভেল করোনাভাইরাস মহামারিতে বিভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রতিপালনের পরেও যখন প্রতিদিন নতুন রোগী সনাক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এমন সময় আমাদের উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে।

অনেকেই মনে করছেন একমাত্র হার্ড ইমিউনিটি’ই পারে এখন কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের গতি হ্রাস করতে।

এক এক জন একেক সময় একেক রকম দাবি করে চলেছেন কেউ বলছেন সংক্রমণের চূড়ায় উঠে গেছে দেশ, কেউ বলছে ইতিমধ্যেই হার্ড ইমিউনিটি শুরু হয়ে গেছে। রোগতত্ত্ববিদ হিসেবে আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই চরম জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় না ঘটিয়ে খুব শীঘ্রই হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের কোনই সম্ভাবনা নেই।
এপ্রিল মাসের তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত কোন দেশেই কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সামগ্রিকভাবে ২-৪% এর বেশি নয়। এমনকি যেসকল স্থানকে সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন নিউ ইর্য়ক, সেখানেও একটি গবেষণার প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী সামগ্রিক জনসংখ্যার মোট ১৫-২১% জনগণ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত। সংক্রমণের পরিমান এই পর্যায়ে পৌঁছাতে নিউ ইর্য়কের মোট ৮.৪ মিলিয়ন জনগোষ্টির মধ্যে ১৭৫০০ জন (অর্থাৎ প্রতি ৫০০ জনের মধ্যে ১ জন) ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে। নিউইর্য়কের সার্বিক মৃত্যুহার পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে যে ১৭৫০০ মৃত্যুর এই সংখ্যাটি আন্ডাররিপোর্টেড বা সত্যিকারের মৃতের সংখ্যা আরও বেশি এবং করোনাভাইরাসজনিত কারনে রিপোর্টেড মৃত্যুহার আরও বেশি হবে।
অনেকেই মনে করছেন চরম জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় না ঘটিয়ে কৃত্রিমভাবে হার্ড ইমিউনিটি ঘটানোর একটি উপায় হল কন্ট্রোলড ভলান্টারি ইনফেকশান যেমনটি চিকেনপক্স রোগের বেলায় ঘটানো হয়েছিল তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
চিকেনপক্সের টিকা আবিষ্কৃত হওয়ার আগে ১৯৮০ সালে চিকেনপক্স রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে চিকেনপক্স রোগে আক্রান্ত শিশুর সাথে সুস্থ্য শিশুদের খেলাধুলার মাধ্যমে সংস্পর্শে নিয়ে আসা হত যেন সুস্থ্য শিশুটিও এই রোগে আক্রান্ত হয়। এতে তাদের শরীরে চিকেনপক্সের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায় এবং পরবর্তী জীবনে সে আর এই রোগে আক্রান্ত হবে না। সেভাবেই কন্ট্রোলড ভলান্টারি ইনফেকশান পদ্ধতিতে একদল সেচ্ছাসেবক একটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আসবে, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে এবং আরোগ্য ঘটলে তাদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোভিড-১৯ আরোগ্য হিসেবে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। সুস্থ্যতার ছাড়পত্র নিয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে যা হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে অবদান রাখবে।
উল্লেখ্য, চিকেনপক্সের তুলনায় করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা অনেক বেশি। ডায়মন্ড প্রিন্সেস ক্রজ শিপে যেসকল যাত্রি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল শতকরা ১%। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ নাগরিকের মৃত্যুর কারন এই করোনাভাইরাস আমেরিকাতে বর্তমানে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারন যেখানে চিকেনপক্সে আক্রান্ত রোগীর বাৎসরিক মৃতের সংখ্যা আমেরিকাতে কখনোই ১৫০ এর বেশি ছাড়ায়নি। অর্থাৎ যে বা যারা এই প্রস্তাবিত করোনাভাইরাস পার্টিতে অংশগ্রহণ করবে তারা ৩০ দিনের মাঝে শুধুমাত্র নিজেদের মৃত্যুই নিশ্চিত করবে না, বরং একই সাথে ঝুঁকির মুখে ফেলবে তাদের পরিবার এবং তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষকে।
করোনাভাইরাসের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে প্রায় ৭০% বা তারো বেশি পরিমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হওয়ার আগে এই পরিমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে হলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হতে হবে। আমেরিকায় যদি বর্তমানের কোভিড-১৯ এ সংক্রমণের হার বজায় থাকে ( প্রত্যহ ২৫০০০+ নতুন সংক্রমন) তাহলেও ৭০% বা তারো বেশি পরিমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। এ সময় যদি বর্তমান কোভিড-১৯ রোগের মৃত্যুহার সমানভাবে বজায় থাকে তাহলে ততদিনে অর্ধেক আমেরিকান মারা যাবে।
আমরা যখন লকডাউন তুলে নেওয়ার আলোচনা করছি, এমন অবস্থায় আমাদের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নিজেদের অসহায়ত্বটাও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বা সিনড্রোমিক সারভিল্যান্স না বাড়ালে আমরা রোগটির বিস্তারের ধরন সর্ম্পকে আরও বিস্তারিত জানতে পারব। ইতিমধ্যে যা জানা গিয়েছে তা থেকে মাত্র এটুকুই পরিস্কার যে কোভিড-১৯ রোগটি মাত্রই তার সংক্রমণের বৈচিত্রতা দেখাতে শুরু করেছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পরিকল্পনা করার সময় আমাদের কথ বার্তা, চিন্তা ভাবনা ও কাজকর্মে আরও সতর্ক হতে হবে।
মূল লেখাঃ
https://coronavirus.jhu.edu/…/early-herd-immunity-against-c…
https://www.firstpost.com/tag/controlled-voluntary-infection
https://www.medicalnewstoday.com/articles/323728
অনুবাদ: ডা. মোঃ রিজওয়ানুল করিম
রাইয়ান আমজাদ
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন


Previous articleবিশ বছরের কম বয়সীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি তুলনামূলক কম: গবেষণা
Next articleপোষ্য থাকার সুবিধা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here