যখন আপনি ভালভাবে কাজ করতে পারছেন তখন অযথা কেন নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হবেন না? এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রশ্নটিও অবান্তরস্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকার বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে ভাবি কারণ এর সঙ্গে মনের সন্তুষ্টি এবং জীবনের ইতিবাচককাজগুলি যুক্ত।
উপরের বক্তব্য থেকে আপনি ঠিক কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন? এই ক্ষেত্রে আপনার মনে প্রথমেই যে ধারণাটি আসবে, সেটি হল, শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন সকালে উঠে জগিং করা অথবা জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা। আর নিদেন পক্ষে কিছু না হলে সকালে উঠে হাঁটাহাঁটি করা। এই সবগুলিই আপনি টেলিভিশনে, যে কোনও হেলথ-ফুডের বিজ্ঞাপনে বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ম্যাগাজিনগুলিতে হামেশাই দেখতে পাবেন।
এখন আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনার চিন্তায় কি কখনও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে? আপনি কি কাউকে নিজের মানসিক সমস্যা বা দুর্দশার কারণগুলি নিয়ে তাঁর বন্ধু বা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে আলোচনা করতে দেখেছেন? আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, কোনও ব্যক্তি তাঁর রেগে যাওয়ার কারণটি বোঝার চেষ্টা করে তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন? আপনার চোখের সামনে কি এমন কোনও ছবি আছে, যেখানে কেউ তাঁর উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজে থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছেন? আপনি এমন একজন মানুষকে দেখাতে পারবেন, যিনি অপর কারও সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করার জন্য বা জীবনে ইতিবাচক কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে চলেছেন?
আমার অনুমান, এই সব প্রশ্নের উত্তর ‘না’ ছাড়া আর কিছুই নয়। উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর তখনই ‘হ্যাঁ’ হওয়া সম্ভব যখন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়বে।
আসলে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা উঠলেই আমাদের মনে আসে মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি এবং আমাদের চিন্তাধারায় মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি তখনই আলোচ্য হয়ে ওঠে, যখন কারও মধ্যে মানসিক ভাবে স্বাভাবিক না থাকার লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ বা মানসিক সমস্যাগুলির সমাধানে শারীরিক সুস্থতা এবং সতেজতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং পারস্পরিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে মানসিক সুস্থতার সম্পর্কটি বেশ জটিল। অর্থাৎ, যাঁর টাইপ টু ডায়াবেটিস মেলিটাস রয়েছে, তাঁর মানসিক উদ্বেগের মাত্রাও একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা দুটোই খুব দরকারি বিষয় এবং একে অন্যের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
জীবনযাপনের পদ্ধতি এবং অভ্যাসগুলি একজনকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে প্রভূত সাহায্য করতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া জরুরি, কারণ এর উপর আমাদের জীবনের ইতিবাচক মনোভাব এবং উৎপাদনশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। ‘গ্যালাপ’-এর একদল বৈজ্ঞানিকের গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা গিয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন বা পরিচর্যার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যেহেতু বিষয়টি মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেহেতু এটি বিমূর্ত এবং অস্পষ্ট একটি ধারণা।
মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ তথা মানসিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কিছু মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মধ্য দিয়ে আমাদের মনের নেতিবাচক অনুভূতিগুলির নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এটি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স এবং দ্য ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সাইকোলজিক্যাল স্টাডিজ-এর গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধান চটজলদি হওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য একদিকে যেমন রোগীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমন অন্যদিকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শও জরুরি। এইভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা সম্ভব। তাই আর দেরি না করে আমরা মানসিক ভাবে এখনই এর জন্য প্রস্তুত হই।
লেখকঃ ডা.সীমা মেহেরোত্রা ,অধ্যাপক, ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগে,নিমহানস।