যে কোনো সন্ত্রাসী হালার খবর সবসময়ই ভীতিকর। কিন্তু অভিভাবকদের জন্য এরকম খবর বাড়তি চিন্তার কারণ তৈরি করে। কারণ সন্তানদের কাছেও ঐ খবর সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাদের।
সহিংস সন্ত্রাসী হামলা সংক্রান্ত খবর শিশুদের জানানোর ক্ষেত্রে সাধারণত অভিভাবকরা যেসব দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকেন – আমি কী খবরটা তাদের কাছ থেকে গোপন করবো? তাদেরকে খবরের বিষয়ে জানতে না দেয়ার চেষ্টা করাই কি সবচেয়ে সহজ পন্থা? নাকি ঠিক যা ঘটেছে তাই আমার সন্তানদের জানাবো?
খবরের বিষয়ে কথা বলুন
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এধরণের বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে শিশুদের সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলাই বেশি কার্যকর।
ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন শিশু। এছাড়াও অনেক শিশুই এই হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
মনোবিজ্ঞানী এমা সাইট্রন, যিনি শিশুদের মানসিকতা ও মানসিক আঘাত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, মনে করেন এ ধরণের ঘটনা সম্পর্কে শিশুদের সাথে কথা বলার বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
“ঘটনা সম্পর্কে শিশুদেরকে জানানো, এবিষয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া এবং তাদের কৌতুহল নিবৃত্ত করতে যা আলোচনা করা প্রয়োজন সেসম্পর্কে দ্বিধা করা উচিত নয়।”
“তাদের পাশে থাকুন এবং তাদের আশ্বস্ত করুন, তাদের আলিঙ্গন করুন, তারা কাঁদলে প্রয়োজনে তাদের সাথে কাঁদতেও দ্বিধা করবেন না। যেভাবে তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, ঠিক সেভাবেই তাদের সাথে ব্যবহার করুন।”
মিজ. সাইট্রন বলেন, “আমাদের জানা প্রয়োজন শিশুরা এরকম একটা ঘটনা ঘটলে কী জানতে চায়, কী ধরণের প্রশ্নের উত্তর চায়।”
টেলিভিশন কি বন্ধ করে দেয়া উচিত?
কোনো সহিংস সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলে শিশুদের কাছে যেন সহিংসতার চিত্র না পৌঁছায়, সে উদ্দেশ্যে টেলিভিশন বা রেডিও বন্ধ করে দেয়া খবুই স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া।
তবে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রির চিকিৎসক বার্নাডকা ডুবিকা মনে করেন, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে শিশুদের কাছ থেকে এরকম খবর গোপন করার চেষ্টা আসলে সময়োপযোগী কোনো পদক্ষেপ নয়।
“বর্তমান যুগে অভিভাবকরা এধরণের খবর শিশুদের কাছ থেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রাখতে পারবেন না। বাস্তবতা হলো, সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে শিশু আর তরুণরা ২৪ ঘন্টাই খবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে।”
মিজ. ডুবিকা বলেন শিশূদের কাছ থেকে অভিভাবকরা কোনো খবর গোপন করলে পরে যখন শিশুরা ঐ খবর সম্পর্কে জানতে পারে, তখন অভিভাবকরা তাদের (শিশুদের) শতভাগ সহায়তা করতে সক্ষম হয় না।
রগরগে বিবরণ এড়িয়ে চলুন
শিশুদের সাথে সহিংসতার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা যেমন জরুরি, তেমনি তাদেরকে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন মিজ সাইট্রন।
“শিশুদের সহিংসতার ঘটনা জানানোর সময় রগরগে বিবরণ এড়িয়ে চলুন, এটা অপ্রয়োজনীয়।”
“রক্তাক্ত ঘটনা, সহিংসতার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া, ছবি বা ভিডিও দেখে কীরকম অনুভূতির জন্ম নেয় – শিশুদের এমন বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। এধরণের বর্ণনা শিশুদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে।”
মিজ সাইট্রন মনে করেন, শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স একটু বেশি, অনলাইনে খবরের কতটুকু তাদের দেখা উচিত সেবিষয়ে তাদের (শিশুদের) সাথে প্রয়োজনে কিছুটা রুক্ষ আচরণও করতে পারে অভিভাবকরা।
মিজ সাইট্রন বলেন, “আমাদের পরিবারের কমবয়সীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এটি খুবই জরুরি।”
সঠিক ভাষার ব্যবহার
মিজ সাইট্রন বলেন, এরকম সহিংস কোনো আক্রমণ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত শিশুদের আলোচনার কেন্দ্রে গিয়ে আলোচনার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা।
কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের (অভিভাবকদের) ধীর-স্থির থাকা এবং তাদের আশ্বস্ত করে, এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত।
“সাধারণ কিছু কথা এরকম ক্ষেত্রে যা শিশুদের আশ্বস্ত করতে পারে। যেমন, ‘এটি খুবই বিরল একটি ঘটনা’ বা ‘এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরো কড়াকড়ি আরোপ করা হবে’।”
“আমরা চাই না আমাদের শিশুরা ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাক। আমরা চাই না যে তারা বড় হয়ে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভীতির সম্মুখীন হোক,” বলেন মিজ. সাইট্রন।
কিন্তু শিশুর জিজ্ঞেস করতে পারে – ‘এমন ঘটনা কি আবার ঘটবে’? সেক্ষেত্রে কী করবেন?
মিজ সাইট্রন বলেন, “এরকম ক্ষেত্রে শিশূদের সত্য বলা উচিত, কিন্তু পাশাপাশি তাদের আশ্বস্ত করাও জরুরি।”
অর্থাৎ শিশুদের বোঝানো উচিত যে এমন ঘটনা আবারো ঘটতেই পারে কিন্তু সেটিও হবে খুবই অপ্রত্যাশিত। পাশাপাশি তাদের আশ্বস্ত করা প্রয়োজন যে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ব্যভস্থা আরো জোরদার থাকবে, সুতরাং এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আরো কম থাকবে।
শিক্ষকদের ভূমিকা কী হওয়া প্রয়োজন?
যুক্তরাজ্যের স্কুল ও কলেজের নেতৃবৃন্দের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কুল অ্যান্ড কলেজ লিডার্সের সাধারণ সম্পাদক জেফ বার্টন মনে করেন, এরকম ঘটনার ক্ষেত্রে স্কুলগুলোর অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ প্রচার করা প্রয়োজন।
অর্থাৎ সহিংস সন্ত্রাসী হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন স্কুল কর্তৃপক্ষের।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত কি-না?
মানসিক আঘাতের চিহ্নগুলো একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেকভাবে প্রকাশ পায়। তবে মানসিক আঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণত শিশুরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে, সেগুলো হলো:
- শিশু অতিরিক্ত ভয় পায়, বিরক্তিকর আচরণ করে এবং অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে যায়।
- প্রায়ই ঘুমের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করে দিতে পারে।
- নিজের চিন্তা এবং স্মৃতি নিয়ে আনমনা হয়ে যাওয়া।
- মনোযোগ দিতে সমস্যা হওয়া।
- অবাধ্য ও খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
- মাথাব্যাথা ও পেট ব্যাথার মত শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়া।
তবে এরকম ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অতিরিক্ত চিন্তিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক বার্নাডকা ডুবিকা।
মিজ. ডুবিকা বলেন, “কিশোর-তরুণদের সিংহভাগই এরকম ঘটনার পর নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করবে।”