প্রথম জীবন থেকেই শিশুর শরীরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনেরও বিকাশ ঘটে। শরীরের বৃদ্ধি মানে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিবর্তন ও আকৃতি বৃদ্ধি পাওয়া। অন্যদিকে মনের বিকাশ মানে শিশুর জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, আবেগ ও অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করার দক্ষতা অর্জন করা। শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বৃদ্ধি বা মনের বিকাশ ঘটারও সুযোগ করে দিতে হবে সমানভাবে।
গর্ভাবস্থা থেকে প্রথম পাঁচ বছর শিশুর বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবনের প্রথম বছরগুলোতে শিশু যা শেখে, যেভাবে শেখে তাই তাদের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব, নৈতিক ও সামাজিক আচরণের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক বিকাশ মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর নির্ভরশীল।
গর্ভবতী মায়ের সুষম খাবার, শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা গর্ভস্থ শিশুর নিউরনের সুষ্ঠু বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। জন্মের পর এ কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় না, তবে পারস্পরিক ক্রিয়ামূলক উদ্দীপনার দ্বারা নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটে এবং সেগুলো সক্রিয় হয়। এজন্য শিশু যাতে তার পাঁচটি ইন্দ্রিয় প্রতিদিন বারবার ব্যবহারের সুযোগ পায় তার দিকে যত্মবান হতে হবে। এতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষের মধ্যে সংযোগ ঘটবে এবং বারবার ব্যবহৃত সংযোগগুলো স্থায়ী হয়ে শিশুর দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকবে। শিশুর প্রথম জীবনে এ ধরনের বিকাশের জন্য বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বিশেষ ভূমিকা প্রয়োজন।
এ বয়সী শিশুর যা পারা উচিত:
– সুসামঞ্জস্যপূর্ণ চলাফেরা করতে পারবে।
– সম্পূর্ণ বাক্যে কথা বলতে এবং ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করতে পারবে।
– গান গাইতে, বই পড়তে, গল্প করতে, ছবি আঁকাতে পারবে।
– বিপরীত অর্থ (যেমন মোটা এবং পাতলা, লম্বা এবং বেটে) বুঝতে পারবে।
– এক পায়ে দাঁড়াতে শেখে। লাফিয়ে সামনে ও পেছনে যেতে পারবে।
– গোল ও ক্রস আঁকতে পারবে এবং চতুর্ভুজ, ত্রিভুজ দেখে দেখে আঁকতে পারবে।
– দৈনন্দিন অনেক রুটিনের বিষয়ে স্বনির্ভর হতে শেখে।
– বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখায়।
– বাবা-মাকে অনুকরণ করতে শেখে।
– ছেলে হলে মায়ের প্রতি, মেয়ে হলে বাবার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।
– ছেলেরা বাবার সঙ্গে এবং মেয়েরা মায়ের সঙ্গে একাত্মতা বোধ শুরু হয়।
– জননেন্দ্রিয় নিয়ে খেলা করে খুশি হয়।
– সমাজে লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপারে অবহিত হতে শুরু করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ শুরু করে। অন্য ছেলে-মেয়েদের শরীর সম্পর্কে কৌতুহল জন্মায়।
– অন্ধকারে ভয় পায়, আঘাত পাবার ভয়ও দেখা দেয়।
– দেওয়া-নেওয়া করতে শেখে।
– ‘আমরা’ কথাটা ব্যবহার করে।
– একসঙ্গে অনেকের সঙ্গে খেলতে শেখে।
– স্কুলে যায় এবং অন্য শিশুদের সাথে নিজ থেকে মিশতে পারে।
– লং জাম্প, হপ স্কিপ ইত্যাদি করতে পারে।
– নিজের জামা নিজে পড়ে এবং নিজে নিজে হাত ধুতে পারে।
– পরিষ্কার কথা বলতে পারে, কথা বলার ধরন বড়দের মতো করার চেষ্টা করে, কথাগুলো মোটামুটি ব্যাকরণ শুদ্ধ হয়। প্রায় এক হাজার এর বেশী শব্দ জানে। গল্প বুঝতে পারে।
– কর্তব্যবোধ জন্মায়, নিজের কার্যক্ষমতায় আত্মপ্রসাদ লাভ করে।
– অন্যদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করে, প্রতিযোগিতামূলক খেলায় উত্সাহী হয়।
– বিভিন্ন খাবারের নাম বলতে পারে এবং পছন্দ মতো খাবার চাইতে পারে। নিজে নিজে খাবার খেতে পারে।
– সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
– পাঁচ থেকে দশটা জিনিস গুনতে পারে।
এ বয়সী শিশুর জন্য যা করণীয়:
– বাচ্চার কথা শুনুন এবং বাচ্চার সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা বলুন।
– যদি বাচ্চা তোতলায়, তবে ধীরে ধীরে কথা বলতে উপদেশ দিন।
– গল্প পড়ুন এবং বলুন।
– শিশুকে বসতে, দাঁড়াতে এবং হাঁটতে সহায়তা করুন।
– নিরাপদ পরিবেশে বাড়িতে ছোটাছুটি বা গড়াগড়ি করতে দেওয়া এমনকি আঙিনা মাঠের সবুজ ঘাসেও ছুটে বেড়াতে দিন।
– বাচ্চাকে খেলতে এবং খুঁটিয়ে দেখতে উৎসাহ দিন।
– শিশুর সঙ্গে লুকোচুরিসহ বিভিন্ন ধরনের আনন্দময় খেলাধুলা করুন।
– হাত-পা নেড়ে হালকা ব্যায়াম করানো এবং সঙ্গে আনন্দসূচক শব্দ করে কথা বলুন।
– কথা বলা, গান গাওয়া, বই পড়া ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর ভাষা শেখাকে উৎসাহিত করুন।
– শিশু যাতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে তার সুযোগ করে দিন – যেমন- ছবি আঁকা, কাগজ, মাটি, পুরাতন কাপড় দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা।
– শিশুরা সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবে তা শেখান এবং ঘরের বাইরে অন্য শিশুর সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিন।
– শিশুকে নিজে থেকে কিছু পছন্দ করা ও দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দিন।
– ভালো কাজের জন্য শিশুকে প্রশংসা, আদর ও পুরস্কার দিন এবং মন্দ বা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের জন্য আদর, প্রশংসা ও পুরস্কার বন্ধ রাখুন।
– পারিবারিক রীতিনীতি ও ভালো-মন্দ শেখান।
– গান, ছড়া ও মজার মজার গল্প বলে শিশুকে সক্রিয় করুন।
– শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ পরিবেশের নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে শিশুর পরিচয় করিয়ে দিন।
– শিশুকে ছোট ছোট প্রশ্ন করুন এবং শিশুর প্রশ্নের জবাব দিন।
– শিশুকে দাঁত মাজা, হাত ধোয়া, নিজে নিজে পোশাক পরা, প্রস্রাব-পায়খানার নির্দিষ্ট স্থান ব্যবহার করতে শেখান।
– শিশুকে পরিবারে ছোট ছোট কাজে উৎসাহিত করুন, পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করুন।
– অন্য শিশু এবং পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিন।
– শিশুরা বড়দের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবে (সালাম দেওয়া, মেহমান এলে বসতে বলা ইত্যাদি) তা শেখান ও পালন করতে উৎসাহিত করুন।
– শিশুকে বকা দেওয়া, মারধর করা ও তাদের সমালোচনা বন্ধ রাখুন।
– শিশুর চারপাশের মানুষজন ও পরিবেশ তার সাথে কী ধরনের আচরণ করে তার ওপরেই অনেকটা নির্ভর করে শিশুর মানসিক বিকাশ। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য যথাযথ সাহায্য করুন।
– শিশুর প্রতিদিন ১৭০০-১৮০০ ক্যালোরী খাদ্য দরকার, তাই শিশুর বিকাশের জন্য সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সমন্নয়ে সুষম খাদ্য খাওয়ান।
– শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বাদাম (যেমন-আখরোট, চিনা বাদাম, কাঠ বাদাম ইত্যাদি) মধু, ডিম, দুধ, মাছ (sea fish), মাছের তেল, ফল (যেমন-কলা, আপেল, জাম, আমলকি ইত্যাদি) ইত্যাদি খাদ্য অতি প্রয়োজনীয়।
– সময় মতো শিশুকে যথেষ্ট (৮ থেকে ১০ ঘন্টা) ঘুমাতে দিন। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কের বিকাশ হয়।
মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ:
নানা কারণে শিশুর বিকাশের সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের যে কোনো ধরনের রোগ, অপুষ্টি, রক্তশূন্যতার কারণে গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রসবকালীন যে কোনো ধরনের জটিলতা বিশেষ করে পরিণত সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু অথবা প্রসবকালীন সময় দীর্ঘ হলে শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা দেখা যায়।
রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বাবা-মায়ের বিয়ে এবং বাবা বা মায়ের বেশি বয়সে জন্ম নেওয়া সন্তান বিকাশজনিত সমস্যার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। অনেক সময় নবজাতকের গুরুতর সংক্রমণ বিশেষত মস্তিষ্কের প্রদাহের যেমন মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস, ব্রেন অ্যাবসেসের কারণেও বিকাশের সমস্যা হতে পারে।
থায়রয়েডসহ অন্যান্য হরমোনের অভাব বা আধিক্য এবং জন্মগত কিছু ত্রুটি ও বিপাক ক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতাও বাধাগ্রস্ত বিকাশের কারণ।
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:
– খেলার সময় বাচ্চা কেমন করে অংশ নেয় লক্ষ্য করুন।
– যদি সে ভীত হয়, রাগারাগি করে বা মারামারি করে সেটা আবেগজনিত সমস্যা বা নির্যাতনের চিহ্ন হতে পারে।
– অসমর্থ শিশুদের খেলতে এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে উৎসাহ দিতে হয়।
– যদি কোনো শিশুর মানসিক বা আবেগজনিত সমস্যা থাকে, নির্যাতিত হয়ে থাকে, তাকে পরামর্শদান করাতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আরও জটিলতার সৃষ্টি না হয়।
– কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সবসময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যত্ন নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারো সঙ্গে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার, ঘরের জিনিসপত্র চুরি করা, বাইরে থেকে অন্যের জিনিস চুরি করে নিয়ে আসা, টাকা পয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা, নিজের শরীরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেড়া, হাত কামড়ানো, মাথা পেটানো), স্কুল পালানো, স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, কানে গায়েবি আওয়াজ শোনা, যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করলে বুঝতে হবে শিশুটি মানসিক সমস্যায় ভুগছে। উপরোক্ত যে কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে বিশেষজ্ঞের মতামত নিন।
– বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্ণয় করতে পারবেন শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে কিনা। সাধারণ ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো শিশুকে রোগী বা অসুস্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
প্রতিটি শিশুর যত্নে ও সুরক্ষায় বেড়ে ওঠার অধিকার আছে । শিশুর চারপাশের জগতের সঙ্গে তার পারস্পরিক ক্রিয়া যদি সমণ্বিত না হয়, আশপাশের মানুষজনের আচরণ যদি বৈরি বা অস্বাভাবিক হয় এবং শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি নিরাপদ না হয় তবে তার মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হয় না। বাবা- মায়ের মধ্যে সবসময় কলহ, পারিবারিক নির্যাতন,পরিবারে মাদকাসক্তি, সমাজ বিরোধী পরিবেশ, অপুষ্টি, শব্দদূষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ইত্যাদিও শিশুর বিকাশের স্বাভাবিক ধারাকে প্রতিহত করে। তাই শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।