১৯৪৮ সাল, শশধর মুখার্জী তার শহীদ চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাকের জন্য শিল্পী খুজছেন। সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার উনিশ বছর বয়সী এক মেয়েকে নিয়ে হাজির হলেন। মেয়েটির গান শুনে “বেশি চিকন গলা, এমন কন্ঠ প্লে-ব্যাকের জন্য নয়” বলে বাতিল করে দিলেন শশধর। বিরক্ত রাগান্বিত হায়দার বলে বসলেন, “একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে“। সেদিন কে জানত, এই ভবিষ্যৎবাণী অতি দ্রুতই সত্য হতে চলেছে?
মেয়েটি আর কেউ নন, ভারতের গানের পাখি লতা মঙ্গেশকর। গানের সুরে কয়েক দশক জুড়ে তার বিজয়ী বিচরণে বিমোহিত হয়েছে বিশ্ব।
শৈশব
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে জন্মগ্রহন করেন গুণী এই গায়িকা। তার আসল নাম হেমা। হেমা থেকে লতা হওয়ার গল্পটা ছিলো এমন- বাবা দ্বীননাথ ছিলেন সঙ্গীত আচার্য । সঙ্গীত ও নাটক- দু’ক্ষেত্রেই ছিল তার সাবলীল যাতায়াত। মঞ্চনাটক লিখতেন, সাথে অভিনয়ও করতেন। নাটকের প্রয়োজনে গানও গাইতেন। ‘ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতীর। তাই সন্তানের নাম হেমা থেকে বদলে লতা রাখা হয়েছিলো।
লতা মঙ্গেশকরের পুরো পরিবারই বলতে গেলে সঙ্গীতের রথী মহারথী ছিলেন। লতার পর একে একে সেবন্তীর কোলে আসেন আশা ভোঁসলে, উষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও সর্বকনিষ্ঠ হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ছোট বোন আশা ভোসলেকে খুব আদর করতেন তিনি। কথিত আছে প্রতিদিন ছোট বোন আশা ভোসলেকে নিজের সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে রাগ করে সেই স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি।
কর্মজীবন
বাবার কাছেই লতার তালিমের শুরু। পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। একদিন দ্বীননাথের নাটকে নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতা কোনো কারণে এসে পৌঁছান নি। তার আবার গানও গাওয়ার কথা। লতা বাবাকে এসে বললেন, তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। প্রথমেই দ্বীননাথ তার প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। ওই অতটুকু নারদ মুনিকে দেখতে যদি জোকার লাগে? লতার পীড়াপীড়িতে শেষটায় রাজি হলেন। লতার অভিনয় আর গান শেষে দর্শকরা “আবার চাই আবার চাই” বলে চিৎকার করেছিল সেদিন।
লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন (১৯৪২ সাল) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার উপর। পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে বললেন।
মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রে দাদা চান্দেকারের রচনা করা গান ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাল’ এ কন্ঠ দেন তিনি। তখনো চলছে তার জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। চলচ্চিত্রের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি তিনি। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগত তার আর ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করার নেই, পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। বসন্ত যুগলকরের ‘আপ কি সেবা ম্যায়’ চলচ্চিত্রে ‘পা লাগো কার জোরি’ গানটি তার প্রথম হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে গাওয়া গান।
বিনায়কের মৃত্যুর পর সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু। নিজের ৮৪তম জন্মদিনে লতা বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। গুলাম হায়দারের হাত ধরে তার জীবনে সুযোগ এল ‘মজবুর’ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড় ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা।
সেই তো সবে শুরু। তারপর শত শত গানে আপ্লুত করেছেন লাখো মানুষকে। ভালোবাসার সাথেই এসেছে অসংখ্য পুরষ্কার ও উপাধি। পঞ্চাশের দশকেই গান করে ফেললেন নামীদামী সব সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে। ষাটের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’ এর মতো এখনো পর্যন্ত তুমুলভাবে বিখ্যাত সব গান।
একবার বেশ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। ডাক্তার জানালো ধীরে ধীরে রোজ কেউ বিষ দিচ্ছে তাকে। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে দেখলেন রাঁধুনি বেতন না নিয়েই পালিয়েছে। তার মতো একজন সদা হাসিমুখ কোকিলকন্ঠীকে কেউ যে কেউ মারার ষড়যন্ত্র করতে পারে, তা ছিলো কল্পনার বাইরে।
১৯৬৩ সাল; ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহরু। সত্তরের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথেই কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, তাদের অনেকগুলো আবার চ্যারিটিও। থেমে থাকেনি সময়, থেমে থাকেননি লতা। তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যার গান রেকর্ডকারী হিসেবে তার নাম আসে। পরে অবশ্য তার এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন নিজেরই ছোট বোন আশা ভোঁসলে। সাত দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এক হাজারেরও বেশী হিন্দি ছবিতে গান গিয়েছেন তিনি। তাছাড়াও মোট ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। মজার ব্যাপার অনেকগুলো ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে বাংলা গানও আছে।
পুরস্কার
ভারতীয় সংগীতের দুনিয়ায় তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ রয়েছে তিনটি জাতীয় পুরস্কার, বারোটি বাঙালী ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন পুরস্কার এবং চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। শেষে অবশ্য তিনি আর ফিল্ম ফেয়ার নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তার মতে, নতুনদের জায়গা করে দেয়া দরকার।
দেশ-বিদেশ থেকেও প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মভূষণ’। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ২০০১ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ অসমারিক নাগরিক সম্মান লতা অর্জন করেন ‘ভারত রত্ন’ খেতাব। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার (অফিসার অফ দি লেজিয়ান অফ অনার) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে।
ব্যক্তিজীবন
ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল, অথচ পারফেকশনিস্ট। দিলীপ কুমার নাকি তাকে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন যে, উর্দুর টান তার ভালো নয়। পরবর্তীতে উর্দু গান গাওয়ার আগে লতা শিক্ষক রেখে উর্দু শিখেছিলেন।
ছবি তুলতে পছন্দ করতেন তিনি। ছোট বোন আশার সাথে তার ঝামেলা নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও, বাস্তবে ছিলো উল্টো। বাড়িতে তাদের দুজনের ঘরের ভেতর কোনো দরজা নেই।
মারাঠী চলচ্চিত্রের রহস্যময় সঙ্গীত পরিচালক ‘আনন্দ ঘন’ ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন। ভূপেন হাজারিকার সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা থেকে শুরু করে আজীবন কুমারী থেকে যাওয়া নিয়ে অনেক কানাঘুষো থাকলেও, তিনি দিব্যি আছেন বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন।
১৯৯৯ সালে পার্লামেন্টের মেম্বার হিসেবে মনোনীত হলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশিরভাগ সময়েই যোগ দিতে পারেননি অধিবেশনে। তার প্রিয় খাবার মশলা জাতীয় খাদ্য ও কোকাকোলা এবং প্রিয় খেলা ক্রিকেট। প্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার।
রোববার সকাল ৮টা ১২ মিনিটে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন সুরের এই স্বরস্বতী। ৯২ বছরে শেষ হলো কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কর্মময় পথচলা। বেশ কিছুদিন আগে করোনাতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চলে গেলেন উপমহাদেশের সংগীতের এই প্রবীণ মহাতারকা।
সুরের কোকিলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ভারতীয় সরকার। লতা মঙ্গেশকরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সোমবার সমস্ত সরকারি অফিসে অর্ধদিবস ছুটি রাখার ঘোষণা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেইসঙ্গে আগামী ১৫ দিন রাজ্যে সুরসম্রাজ্ঞীর গান বাজবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গেছেন হাজারো-কোটি ভক্ত অনুরাগী। সুরের সারথীকে রেখে দিবেন মনের মণিকোঠায়।
লিখেছেন- শরীফুল সাগর