আজিজ সাহেব ভালো মানুষ। মিশুক এবং সামাজিক। তার আশেপাশের মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন। তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কম নয়। তার স্ত্রী তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। দুটি ছেলে আছে তাদের। পাড়া-পড়শিরা তাদের সুখী দম্পতি হিসেবেই জানেন। তার স্ত্রীর মাথাব্যথার জন্য তিনি অনেককিছু করিয়েছেন কিন্তু কিছুতেই মাথাব্যথা ভালো হয় না।
অবশেষে মানসিক চিকিৎসকের কাছে এসেছেন তার এক চিকিৎসক বন্ধুর পরামর্শে। তার স্ত্রী নুসরাত বেগম কোমল স্বভাবের। সবকিছুকে সহজভাবে মানিয়ে নিতেই তিনি অভ্যস্ত। মাথাব্যথার সমস্যা তার দীর্ঘদিনের। চেষ্টা করেছেন তিনি মানিয়ে নিতে কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
আজিজ সাহেবের ভাষায়, মন টন আবার কী! এগুলোকে গুরুত্ব দিলেই গুরুত্ব। মেয়েমানুষের কথায় আমি তেমন কান দেই না। মেয়েমানুষের বুদ্ধি তো বোঝেন। আগে নাপা খেলে কমে যেত এখন নাপায়ও ধরে না। আর নাপা সে খেতেও চায় না।
সিটি স্ক্যান, এমআরআই সবই করলাম। কিছুতেই কিছু ধরা পড়ে না। এদিকে নাপাও খায় না। তাহলে ভালো হবে কীভাবে? ইদানীং আবার ঘুমের সমস্যা, সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। আমি দেখলাম আজিজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলা মুশকিল। কাউকে কথা বলার কোনো স্পেস দেন না। নুসরাত বেগম কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিনি বলে ফেলেন। সব কথা যেন তিনিই বলবেন।
আমাদের সমাজে এমন লোক অনেকেই আছেন যারা মারেন না, ধরেন না কিন্তু অন্যকে স্বাধীনভাবে চলতেও দেন না। তাদের আক্রমণাত্মক আচরণগুলো ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। তাই আজিজ সাহেবের বর্ণনা দিয়েই শুরু করলাম।
আক্রমণাত্মক আচরণ বা মনোভাব বললেই চোখের সামনে যে রাগী চিত্রটা ভেসে ওঠে সেটা ছাড়াও যে আরো অনেক রকমের আক্রমণাত্মক আচরণ আছে, তা বোঝাতেই আজিজ সাহেবের প্রসঙ্গটা তোলা।
রাগ আমাদের একটি অতি পরিচিত অনুভূতি। রেগে গেলে আমরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি। প্রতিরোধী বা ডিফেন্সিভ আচরণ করি। সপ্তাহে একবার, দু-বার রাগে না এমন মানুষ বিরল। গবেষণার ফলাফল এটিই। তাই আক্রমণাত্মক আচরণের প্রসঙ্গ এলে রাগের প্রসঙ্গ আসে।
রাগ ছাড়া আজিজ সাহেবের এ আচরণটি আক্রমণাত্মক। আজিজ সাহেবের এ ধরনের আচরণ তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। সে বিষয়ে আমরা আরো পরে জানতে পেরেছি। এমনকি ভদ্রমহিলার মাথাব্যথার একটা অন্যতম কারণও ছিল আজিজ সাহেবের এ ধরনের আচরণ।
আজিজ সাহেবের আরেকটি অনুরোধ ছিল তার স্ত্রীর যৌন অনীহার ব্যাপারে আমরা যেন কিছু করি। তার ধারণা ভালো শারীরিক সম্পর্ক থাকলে মাথাব্যথাটা হয়ত থাকত না।
সঙ্গীর আক্রমণাত্মক আচরণ যৌন আগ্রহের ওপর প্রভাব ফেলে। যিনি আক্রমণাত্মক আচরণ করেন তার যৌন আগ্রহকে প্রভাবিত না করলেও যার সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করা হয় তার যৌন আকাঙ্খাকে প্রভাবিত করে। যৌনতার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়।
যৌনতা হচ্ছে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার অন্যতম অনুষঙ্গ। দাম্পত্য সম্পর্কে সঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের যে চারটি পথ আছে যৌনতা তার মধ্যে অন্যতম। আক্রমণাত্মক আচরণে সব পথগুলোই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। চিন্তা চেতনার শেয়ারিং, আবেগ অনুভূতির শেয়ারিং যেমন বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি অযৌন শারীরিক বা শারীরিক রোমান্টিসিজম যেমন হাতে হাত রাখা, পায়ে পা ঘষা, চমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা এবং যৌন শারীরিক বা সেক্সচুয়াল রোমান্টিসিজমও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে অনেকেই যৌন অনীহাতে ভোগেন।
শুধু তাই নয়, যারা রেগে যান তাদের বিশেষ করে পরুষদের যৌন আগ্রহ থাকলেও লিঙ্গ যথেষ্ঠ শক্ত হয় না। দুশ্চিন্তার মতো রাগও যৌন উত্তেজনা কমিয়ে দেয়।
আমরা কখন রেগে যাই বা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি?
যখন আমরা অনুভব করি আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কোনো হুমকির মধ্যে পড়েছে। বড় কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্যের কথা বলছি না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে দৈনন্দিন খুঁটিনাটি বিষয়েও কিন্তু আমরা যথাযথ অনুকূল পরিবেশ না পেলে আমরা রেগে যাই বা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি।
অনেক সময় অনকূল পরিবেশকে প্রতিকূল ভেবে আমরা অহেতুক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি। বিশেষ করে যারা দু:শ্চিন্তায় ভোগেন। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাব যখন আমাদের মধ্যে কাজ করে।
প্রতিকারের উপায় :
ইতিবাচক চিন্তা করা, নিয়মিত রিলাক্সেশন করা, নিজের পাশাপাশি অন্যকেও গুরুত্ব দেওয়া, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সঙ্গীর চোখ দিয়েও দেখার প্রাকটিস করা।
মনে রাখতে হবে, সুসম্পর্ক একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়Ñহোক সেটা শারীরিক কিংবা মানসিক। একজনের আক্রমণাত্মক মনোভাব বা আচরণ অন্যজনের স্বতঃস্ফুর্ততাকে নষ্ট করে। আর তা প্রভাব ফেলে সহজ যৌন সম্পর্কের ওপর।
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে