জীবনযাপনের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে ‘স্বাস্থ্য’ অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাস্থ্য বলতে মানসিক এবং শারীরিক উভয় সুস্থতাকেই বোঝায়। এই অধিকার সার্বজনীন হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও বাস্তব পৃথিবীতে দেশ, কাল, সময়, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণেই অসম। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে এই অসমতা আরও যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বলতে এখানে শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবা নয় এর সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা এবং মানসিক রোগের প্রতিরোধ কার্যক্রমসহ বিশাল পরিধিকে বোঝানো হয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য এখন আর কোনো অবহেলার বিষয় তো নয়-ই বরং বিশ্বব্যাপী ডিজিজ বার্ডেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৈশ্বিক রোগের যে হার হিসাব করা হয়, তাতে ৭.৪% ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন মানসিক রোগ, যা কিনা যক্ষ্মা (২%), এইডস (৩.৩%) এবং ম্যালেরিয়া (৪.৬%) রোগের চেয়েও বেশি! মানসিক রোগের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। বিষণ্ণতা রোগের কারণে বিশ্বব্যাপী অক্ষমতার হার ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মাঝে বেড়েছে ৩৭%, ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়বে। এরকম আশঙ্কাজনক সংখ্যার সাথে সাথে আরও একটি ভাবনার বিষয় হলো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। যে হারে রোগ বা রোগী বাড়ছে, সেই হারে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মান এবং সহজলভ্যতা বাড়ছে না।
উন্নয়নশীল এবং উন্নত বিশ্বের মাঝে আর্থিক সামাজিক অনেক কিছুই পার্থক্য এর কারণে মানসিক রোগ এবং স্বাস্থ্যসেবারও অনেক পার্থক্য রয়েছে। স্বল্প এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সাধারণ মানুষের প্রায় সবাইকে বিভিন্ন রকম চাপের চক্রে আবর্তিত হতে হয় এবং এ কারণে মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রবণতাও বেশি কিন্তু এখানেই বড়ো একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়ে রয়েছে যাকে বলা হয় ট্রিটমেন্ট গ্যাপ। ট্রিটমেন্ট গ্যাপ কথার মানে হলো যতজন মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং তাদের চিকিৎসা নেওয়ার, ফলোআপে থাকার মধ্যে যে পার্থক্য, এই গ্যাপটা স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২১ টি দেশের এক জরিপে দেখা যায়, ৫২.৬% বিষণ্ণ রোগীর মাত্র ২০.৫% রোগী চিকিৎসকের কাছে এসেছেন। এই ট্রিটমেন্ট গ্যাপের জন্য প্রধান কারণ হলো দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর অভাব এবং সম্পদের অসমতা ও অপ্রতুলতা। তাই নতুন বিশ্বে নতুন ধারণা হলো
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচার-প্রসার, মানসিক রোগ প্রতিরোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া, অন্যদেরকেও যুক্ত করা যাকে Task Shifting Approach বলা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনা করলে দেখা যায়, নিম্ম আয়ের দেশগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং কমিউনিটি লেভেলে কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিদ্যমান নেই। সুতরাং, এই পার্থক্য এসব দেশে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কর্ম পুনর্বিন্যাসের (Task Shifting) পরিকল্পনা মোতাবেক স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কর্মী এবং কমিঊনিটি কর্মীদেরকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন রকম সেবার সাথে সংযুক্ত করা যেমন সাপোর্টিং সেবা, চিকিৎসার কাল পূর্ণ করা, নিয়মিত ফলোআপে থাকা এবং সহজ কিছু মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা ইত্যাদি।
সেবিকাবৃন্দ, সমাজকর্মীরাও বিভিন্ন শিক্ষামূলক এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, রোগীর ফলোআপ নিশ্চিত করতে পারেন। এর পাশাপাশি যেসব চিকিৎসক জেনারেল প্র্যাকটিশনার তাদেরকেও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মানসিক রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং রেফার করার কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যায়। শিক্ষক এবং শিক্ষার সাথে জড়িত অন্যান্যরা শিশু এবং কিশোর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানসিক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এরকম কর্মসূচি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সফলতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
অসম পৃথিবী মানে এখানে সম্পদ বা রিসোর্স এর অসমতা যার কারণে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে অসমতা তৈরি হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই হোক আগামী পৃথিবীর লক্ষ্য।
ডা. সাদিয়া আফরিন
রেসিডেন্ট এমডি (চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডালসেন্ট সাইকিয়াট্রি)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে