মানসিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশই ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ল্যানসেট কমিশনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও দেশই হতাশা-উদ্বেগ আর সহিংসতা-বিভীষিকা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। মানসিক স্বাস্থ্যের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে তারা বিশ্বের স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সম্মিলিত ব্যর্থতা আখ্যা দিয়েছেন। ল্যানসেটের ২৮ জন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এই পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। তারা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
সারাবিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে ল্যানসেট কমিশন অন গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ। বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায় তারা। কমিশনটি জানায়, বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়ানো উচিত। ২৮ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিন প্যানেলটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময় ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা কাটিয়ে ওঠার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করে। সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে তারা একটি প্রতিবেদন হাজির করেছে। লন্ডনে চলমান মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় পর্যায়ের এক সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে, মানসিক রোগ শনাক্তকরণ ও নিরাময়ের ব্যবস্থা অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে উন্নত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই রোগ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। মানসিক সুস্থতায় চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিস্থিতি শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতিকার ব্যবস্থার থেকেও করুণ। এক্ষেত্রে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই যেন উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে ‘সরকারি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার হার খুবই কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনও কোনও দেশে মানসিক রোগীরা নিপীড়নের শিকার। অনেক দেশেই রোগীদের শেকলে বেধে রাখা হয়, ন্যূনতম মানবাধিকার থাকে না তাদের। কোথাও কোথাও রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাদের। নেই কোনও আইনি নিরাপত্তা। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক বিক্রম পাটেল বলেন, মানসিক অসুস্থতার কারণে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশ্বে এই অসুখে যত তরুণের মৃত্যু হয় আর কোনও রোগে এত সংখ্যক তরুণ প্রাণ হারায় না। বিক্রম পাটেল বলেন, হাজার হাজার মানসিক রোগীকের তাদের নিজ বাড়িতেই শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। আত্মহত্যার চেষ্টায় প্রাণ হারানো ছাড়াও গুরুতর আহত হয়ে পড়েন অনেকে। কেউ কেউ প্রাণ হারান মাদক সেবনে কারণে। পাটেল বলেন, আমরা মানসিক অসুস্থতাকের অত্যন্ত ঝুঁকি বিবেচনা করছি। বিশ্বে যেসব অসুখে মানুষের মৃত্যু হয় সেগুলোকেই বেশি প্রাধাণ্য দেওয়া হয়। কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিবিছর ১ কোটি ৩৫ লাখ মৃত্যু হয় মানসিক অবসাদ ও অসুস্থতার কারণে। একটু সতর্ক হলে এই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।
কিছু কিছু দেশে এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা পাওয়ার কোনও আশাও নেই। ভারত ও চীন, যেখানে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস। সেখানে ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন কিন্তু কোনও চিকিৎসা নিতে চান না। আর যখন তারা চিকিৎসা নিতে চান, সেটাও খুব নিম্নমানের হয়। যারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত তারা অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও শিকার হয়। বিশেষ করে সিজিওফ্রেনিয়া ও স্বাভাবিক চিন্তায় অক্ষম ব্যক্তিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাজার হাজার মানসিক রোগীকে নিজ বাসায়, উপাসনালয় কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেধে রাখা হয়। আর যখন তাদের মুক্ত করা হয় তখনও পর্যাপ্ত যত্ন নেওয়া হয় না। ফলে গ্রেফতার হতে হয় কিংবা কখনও কখনও মৃত্যুও হয়ে থাকে তাদের। ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এমন একই রকমের একটি ঘটনা ঘটে। গুতেং ডিপার্টমন্টে অব হেলথ দুই হাজার শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় ফলে ঝুঁকির মুখে থাকা অনেক মানসিক রোগীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় এরপর ১৪০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মজীবী মানুষেরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে ১৬ ট্রিলিউন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব। বিশ্বব্যাংকের করা ক্ষতির হিসেবের ওপর ভিত্তি করেই এই অনুমান দাঁড় করানো হয়েছে।