দেহ, মন, কাজ, জীবন-আমাদের সার্বিক অবস্থার প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য বা মানসিক রোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান। সেটা প্রদর্শন করে দিন দিন গবেষণার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সর্বাধিক অক্ষমতার প্রথম দশটা রোগের মধ্যে পাঁচটিই মানসিক রোগ। কিন্তু আমাদের জীবনের বাস্তবতায় মানসিক রোগকে সবসময় হালকা করে ও কম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ব্রিটেনে ১৫-৩০ ভাগ লোক তাদের কর্মক্ষম সময়ে মানসিক সমস্যায় পড়েন। ইউরোপের অন্যান্য দেশে সেটা প্রায় ২০ ভাগ বলে গবেষণায় পাওয়া যায়। মানসিক সমস্যা শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে তা নয়; সামগ্রিকভাবে শিল্প, সমাজ ও দেশের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত করে।
পেশাগত বা কর্মক্ষেত্রে রোগের জন্য যে খরচ হয় তার মধ্যে মানসিক রোগ তৃতীয়। এর আগে আছে হাড্ডিমাংস ও হার্টের রোগ। ইউরোপে মানসিক রোগের অক্ষমতার জন্য পেন্সিয়ানেরও ব্যবস্থা আছে। এই খরচ কয়েকভাবে বিবেচনা করা হয়। যেমন-চিকিৎসার জন্য ‘সরাসরি-খরচ’, রোগীর সেবা প্রদান, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যস্ত থাকার জন্য ‘পরোক্ষ-খরচ’ এবং রোগে আক্রান্ত থাকার জন্য ‘সুযোগ-খরচ’। অর্থাৎ রোগের জন্য যেসব আয় করার সুযোগকে ছাড় দিতে হয়েছে। উপরন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির তুলনায় বাড়তি কিছু অসুবিধায় পড়েন যেমন-লজ্জা, ভয়, তির্যক সামাজিক আচরণ।
কাজ, কাজের জায়গা, কাজের পরিবেশ আমাদের দেহ ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে সার্বিকভাবে। আবার আমাদের দেহ ও মন কাজ, কাজের জায়গা ও কাজের পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে। সুন্দর স্বাস্থ্য ও সুন্দর কাজের পরিবেশ একটি আরেকটির পরিপূরক। কাজের জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বসহকারে দেখার জন্য গবেষণায় কয়েকটি মানদ- বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে সময়ের বাইরে অফিসে থাকতে বাধ্য না করা ছিল সবার আগে। কাজের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ কর্ম-পরিবেশকে আরামদায়ক করে। কাজ পরিবারের বাইরে আর একটা সামাজিক পরিচয় নির্মাণ করে। যে পরিচয়টি সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে সমুন্নত রাখতে পারলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে এবং সর্বোপরি সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
কর্মক্ষেত্রে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা উল্লেখ করা হলো:
মানসিক রোগী মানেই বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী। কিন্তু বাস্তবে এটা ঠিক নয়। বুদ্ধি-প্রতিবন্ধিত্ব একপ্রকার মানসিক রোগ মাত্র যেটার প্রাদুর্ভাব সামগ্রিক মানসিক রোগের তুলনায় খুব অল্প।
মানসিক রোগ একবার হলে আর ভালো হয় না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় মানসিক রোগ নিয়ে অনেক লোক উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে জড়িত। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এই রোগের চলন, গঠন অনেক পরিবর্তন করেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো করবে। প্রয়োজন হলো অতিসত্বর রোগ নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা শুরু করা। সেই সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন যাতে একজন মানসিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সংকটময় মুহূর্ত কাটিয়ে আবার কাজে যোগ দিতে পারেন ও কাজ চালিয়ে নিতে পারেন।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি বা পূর্বে মানসিক রোগ ছিল এমন ব্যক্তিদের কর্মদক্ষতা কমিয়ে রেটিং করা হয়। কিন্তু বাস্তবে গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মালিক তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা দেখেছেন স্বাভাবিক গড়পড়তা থেকে তাদের কাজের মান ভালো। মানসিকভাবে অসুস্থ লোক কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস নিতে পারে না। বাস্তবে বলা হয়ে থাকে এটা একেবারেই সোজাসাপটা বলা খুব কঠিন এবং গবেষণায় এরকম প্রত্যক্ষং সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
মানসিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আগে থেকে অনুমান করা যায় না, তারা আক্রমণাত্মক হয় ও অন্যের ওপর চড়াও হয়। বাস্তবে এই মতকে সমর্থন করে কোনো গবেষণার ফলাফল পাওয়া যায়নি।
তথ্যূসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।