ইচ্ছেতলা। রাজধানীতে গড়ে ওঠা একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তা জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি। এই ইচ্ছেতলা ও শিশুশিক্ষা নিয়ে মনের খবর-এর পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন সাদিকা রুমন।
ইচ্ছেতলা কবে যাত্রা শুরু করে?
ইচ্ছেতলা প্রথম আমরা শুরু করি ২০১৬ সালে ১১ মাচর্।
ইচ্ছেতলা ঠিক কী ধরনের স্কুল?
এটাকে আমরা ঠিক স্কুল বলব না। স্কুল বলব না এই জন্য- স্কুলের কনসেপ্টটা এমন যে, স্কুলে কোনো বিষয়ে জ্ঞান অজর্ন করতে হয়, সেটা আবার পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ দিতে হয়। এটাকে আমরা বলতে পারি একটা কেন্দ্র। এটা আসলে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতা বা সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। আমাদের এই সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের মূল ফিলোসফিটা হচ্ছে- বাচ্চারা এখানে এসে সংস্কৃিতর বিষয়গুলো নিয়েই ছোট ছোট করে কাজ করবে; কোনো একটা বিষয়কে যদি ভালোবেসে ফেলে, সেই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে চায় তখন সেই বিষয়টাতে সে স্পেশালাইজড হয়ে উঠবে। আমরা বলতে চাইছি, সৃজনশীলতা আলাদা কিছু না; এটা আসলে সবসময় চলার একটা পথ। এখানে কখনো হয়তো ওরা সিনেমা দেখে প্রজেক্টরে, কখনো লাইব্রেরির থেকে বই নিয়ে পড়ে। পহেলা শ্রাবণে আমরা গাছ লাগাই ছাদে। পহেলা শ্রাবণকে আমরা ধরে নিয়েছি গাছ লাগানোর উৎসব। আমরা চৈত্রসংক্রান্তি করি, মঙ্গল শোভাযাত্রা করি। আগের বছর প্রবারণা পূণির্মাতে আমরা ফানুস উড়িয়েছি, ক্রিসমাস করেছি গতবার। ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারী একটা শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম ছোট্ট করে। ওরা নিজেরাই সেটা সাজিয়েছে। ওদেরকে নিয়ে রবীন্দন্রাথের ‘বীরপুরুষ’ থেকে একটা নাটক করেছিলাম। এখন ‘তোতাকাহিনী’ নিয়ে কাজ করছি। ওদের নিয়ে চড়ই–ভাতি করেছিলাম এবার- দোতলা বাসে করে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম, যাতে ওরা দোতলা বাসে চড়ার মজাটা পায়। এভাবে ওদেরকে সব বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করি। আমরা চাই, ছেলে-মেয়েরা এখানে আসকু, ওদের মনের মুিক্ত আসকু, ওদের কিছু সুন্দর সময় কাটুক। প্রতি শুক্রবার ও শনিবার বিকেলে ঘণ্টা তিনেক সময়ের জন্য বাচ্চারা ইচ্ছেতলায় আসে। ওদের জন্য সব ধরনের সাবজেক্ট মিলিয়ে একটা সিলেবাস আমরা তৈরি করে রেখেছি। যেমন- শুক্র ও শনিবার দু’দিনই ওদের দুটো ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির ক্লাস থাকে। একটা দিনে আমরা রেখেছি মার্শাল আটর্সের বেসিক ওরিয়েন্টেশন। আরেকদিন থাকে কনটেমপোরারি ড্যান্স। এছাড়া চারুকারু, বাংলা চর্চা, গান রয়েছে। বাংলা চর্চা ক্লাসে ওরা হয়তো গল্প লেখে বা গল্প শোনে বা ছড়া-কবিতা পড়ে, কিছু ক্রিয়েটিভ রাইটিং করে। গানের ক্লাসটাও একই রকম- ওরা হয়তো সারগাম শিখছে, টুকটাক তাল শিখছে। তার মানে এই না যে, ওরা সংগীতশিল্পী হওয়ার জন্যই গান শিখছে; গান ভালো লাগার জন্যই ওরা গানটা শিখছে।
ইচ্ছেতলা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
খুব শিগগিরই আমরা ‘টিনক্লাব’ নামে আরেকটা উদ্যোগ শুরু করতে যাচ্ছি। তের থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা এখানে আসবে। তোমরা যে কাজটা করছ এই জিনিসটা ওদের সবচেয়ে বেশি দরকার। মানসিক সাপোটর্টা ওদের সব থেকে বেশি দরকার। কারণ এই সময়টা ওরা সব থেকে বন্ধহুীন থাকে। পড়াশোনার চাপ বেশি থাকে। এই সময় ওদের শারীরিক-মানসিক পরিবতর্ন আসে, ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো অনেক সুনিদির্ষ্টভাবে তৈরি হয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়- সবকিছু মিলে ওরা একটা ভালনারেবল পজিশনে থাকে। বিশেষ করে এখনকার নিউক্লিয়াস পরিবারগুলোতে এটা আরো বেশি হয়। অথর্নৈতিক টানাপোড়েনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে বাবা-মা দুজনকেই কাজ করতে হয়। তখন ছেলে-মেয়েরা আরো একলা হয়ে যায়। তাদের মানসিক সাপোটর্টা দেয়ার জন্যই আমরা টিনক্লাবের কথা ভাবছি। আগে কিন্তু প্রত্যেকটা পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল। এখন ক্লাব কালচারটা চলে গেছে। এখন যে বিভিন্ন রকমের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই অপরাধীর মনের ওপর দিয়ে কী গেছে, সেসব ট্র্যাক না করলে তো বোঝা যাবে না। কিন্তু কে ট্র্যাক করবে? বাবা-মা ব্যস্ত বা তাদের সে এডুকেশনটা নেই। আগে ক্লাব, কচিকাঁচার আসর বা খেলাঘর ছিল। সেখানে কেউ না কেউ থাকত, যে আসলে মেন্টর হিসেবে ছেলে-মেয়ের ওপর প্রভাব রাখতে পারত। এখন সে অবস্থাটা আমাদেরকে গড়ে দিতে হবে। আমার কাছে মনে হয় শিশু-কিশোরদের জন্য যত বেশি সংগঠন তৈরি হবে, তত বেশি পজিটিভ পরিবতর্নের সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই মুহূর্তের আমাদের কাযর্ক্রমগুলো মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এদের জন্যই সীমাবদ্ধ। এখানে যারা আসছে তাদের বাবা-মা’দের অর্থনৈতিক ইনভলভমেন্টও থাকছে। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আছে খবু শিগগিরই আমরা আন্ডার প্রিভিলাইজড বাচ্চাদের জন্য কাযর্ক্রম রাখব। এছাড়াও এখানে আমরা ছোট্ট অংশ তৈরি করতে চাই- বাবা-মার স্কুল; প্যারেন্টিংয়েরও একটা স্কুলিংয়ের প্রয়োজন। ২০১৮ সালে আমরা খুবই কনস্ট্রাকটিভ কিছু ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করছি। আমরা বাচ্চাদের জন্য তিন বছর মেয়াদি একটা কোর্স-পরিকল্পনা করছি। প্রথম বছর হলো- প্রকৃতিপাঠ। দ্বিতীয় বছর থাকবে-দেশ ও মানুষ। তৃতীয় বছরে সংস্কৃতির যে শাখাগুলো নিয়ে ওরা কাজ করছে সেগুলোর আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া। আমার খবু ইচ্ছা যে ইচ্ছেতলা, টিনক্লাব নিয়ে একটা মডেল তৈরি করতে পারলে সেই মডেলটা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া।
এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনাটা কি অনেক দিনের?
না, ঠিক অনেক দিনের না। অনেক আগে মনে হতো, এমন একটা স্কুল তৈরি করতে পারলে ভালো হতো, যেখানে বাচ্চারা প্রতিদিন সকালে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের ‘মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমপর্ণ’ গানটা গাইবে। সেগুলো ছিল সব খুচরো ভাবনা। ২০১৬ সালে আমি বড়দের জন্য একটা একাডেমি নিয়ে কাজ করছিলাম- বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন একাডেমি। সেটা করতে গিয়ে দেখলাম, গত বিশ-পঁচিশ বছরে একটা বড় সমস্যা ঘটে গেছে আমাদের সমাজে। সমস্যাটা হচ্ছে- সংস্কৃতিচর্চাটা কমে গেছে। ছোটবেলায় আমরা যেমন দেখেছি সন্ধ্যাবেলায়- আজানের ধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে সারেগামার আওয়াজও পাওয়া যেত। এখন কিন্তু ‘আমরা কোনো গান শুনতে পাই না। কিংবা কোনো বাড়িতে গেলে দেখতাম শোভাবধর্নকারী একটা বুকশেলফ আছে; এখন সেখানে বিশাল বিশাল স্ক্রিন এবং সে স্ক্রিনে প্রচুর টেলিভিশন অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানগুলো কার জন্য প্রয়োজন, কোনটা কে দেখবে, কোনটা কে দেখবে না- এমন কোনো ব্যাপার নেই। এই অভাববোধ থেকেই ইচ্ছেতলা’র ইচ্ছেটা জন্ম নেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজটা শুধু বাহ্যিকভাবে ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠলেই হবে না। সমাজ তো শুধু এসব বাহ্যবস্তু না, কিছু মানুেষর সমষ্টি; তার ভেতর তো একটা প্রাণ আছে। সেই প্রাণটাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটাই আমাদের ভাবতে হবে। আমি এইচএসসি পাস করেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হই। আমি মনে করি সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বলেই একটার পর একটা দরজা আমার জন্য খু্লে গেছে। এজন্যই আমরা বলছি, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার চর্চাগুলো আসুক এবং দরজা-জানালাগুলো খুলে যাক। ধুলা-বালি-বৃষ্টি-আলো সব আসুক; তবুও দরজা-জানালাগুলো খোলা থাক। রবীন্দন্রাথের গান দিয়েই বলি- যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে/ মুক্ত কর হে বন্ধ। এই ‘বন্ধ’টা খুলে যাক। মূলত আমরা চাইছি, বাচ্চারা দলে কাজ করুক, প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসুক, দেশটাকে জানুক; সবকিছুর প্রতি ওর ভালোবাসা তৈরি হোক। সবকিছু ও আনন্দ নিয়ে করুক। ‘ভালোবাসা’ এবং ‘আনন্দ’ শব্দ দুটো খুব জরুরি জীবনের জন্য। বই ওর বন্ধু হোক, গান ওর বন্ধু হোক, গল্প ওর বন্ধু হোক, প্রকৃতি ওর বন্ধু হোক, মানুষ ওর বন্ধু হোক।
বতর্মান প্রেক্ষিতে সংস্কৃতিচর্চাটাও অনেক সময় বাচ্চাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়- এই জায়গাটা থেকে আমরা বেরোতে পারব কীভাবে?
এটাই তো আমি বলছিলাম যে, আমরা যদি এই মডেলটাকে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারি, তাহলে এটাই সবাইকে দিয়ে দিতে পারব। আমি শুধু বাবা-মা’দেরকে বলতে চাই, আপনারা বিষয় নির্বাচন করে দেবেন না, ও সবগুলো বিষয়ের মধ্যে ঘোরাঘুরি করুক না! এটা অনেকটা কালার প্যালেটের মতো। ওর সামনে লালনীল-হলুদ-সবুজ সব রঙ আছে। ও কোনটা দিয়ে ছবি আঁকবে এটা ওর নিজের ইচ্ছে। ওর জীবনের ক্যানভাসটা ও নিজেই তৈরি করুক না।
পড়াশোনার চাপ কমিয়ে ভারসাম্য আনা কি সম্ভব?
এই ভারটা তো কমবে না। আমি তো অভিভাবকদেরকে বলি, আপনারা কেন স্কুলগুলোর সঙ্গে কথা বলেন না? তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক কাঠামোটাকে পরিবতর্ন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমি গবেষক নই, আমি শুধু আমার অনভূতিটুকুই বলছি- একটা লোক যদি ১০-৫টা অফিস করে বাকি সময় নিজের মতো কাটাতে পারে, অফিস থেকে ফেরার পর যদি তার নিজস্ব সময় থাকে, তাহলে একটা বাচ্চা কেন স্কুলের পড়া স্কুলে করে ফিরতে পারবে না! তার কেন আনন্দ নিয়ে কাটানোর সময়টুকুু থাকবে না! একটা বাচ্চা তার শৈশব এবং কৈশোরটা আনন্দ নিয়ে যাপন করুক! ‘ভালো’ এটুকুুতে কেন আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না, সবাইকে কেন শ্রেষ্ঠ হতে হবে!
কেউ যদি ভাবে যে তার বাচ্চাকে এই চাপ থেকে মুক্ত রাখবেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠে না। এটা কেন হয় বলে আপনি মনে করেন?
এর পেছনে সামাজিক চাপ আছে, পারিবারিক চাপ আছে। অনেক অভিভাবকই আমাকে বলেন, ‘আমি চাই না আমার বাচ্চা খালি পড়ুক–। আমি চাই ও একটু আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠুক।’ হয়তো মা এভাবে চাইলেন, কিন্তু বাচ্চার বাবা চাইলেন না। কিংবা বাবা-মা দুজনেই হয়তো চাইলেন; তখন তাদের পরিচিতজনরা বলতে শুরু করল- তোমার বাচ্চা পড়াচ্ছ না কেন? ওকে কোচিংয়ে দাও, টিউটরের কাছে দাও। আসলে এই মুহূর্তে বাবমা’র স্কুলিংটা বেশি দরকার। প্যারেন্টসরা কী চাইছেন, কেন চাইছেন সেটা জানা দরকার। বাবা-মা’দের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার খুব মন খারাপ হয়, বাবা-মায়েরা কীরকমভাবে খেটে চলেছেন শুধু টাকা উপাজর্নের জন্য! কেন? কারণ হচ্ছে- ফ্রেঞ্চ শেখাতে হবে, কোচিংয়ে দিতে হবে, এখানে-সেখানে নানা জায়গায় দিতে হবে। আমার মাঝে মাঝে খুব অমানবিক লাগে। বাচ্চারা কি ক্লান্ত হয় না! বাবা-মা’রা কি ক্লান্ত হন না!
বাচ্চাদের জন্য অল্প করে হলেও কিংবা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও বিভিন্ন কিছু গড়ে উঠছে, যেমন- ভিন্ন ধরনের স্কুল, সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, ক্রিয়েটিভ স্কুল; সম্প্রতি একটা টিভি চ্যানেলও চালু হয়েছে- এটা কি ইতিবাচক পরিবতর্নের আভাস?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু দেখ, বাংলাদেশে প্রথম প্রাইভেট চ্যানেল হয়েছে কুড়ি বছর আগে। আর বাচ্চাদের একটা চ্যানেল আসতে সময় লাগল কুড়ি বছর। এই যে কুড়ি বছরের গ্যাপ এটা পূরণ হবে কী করে! আমি তো সবাইকে বাচ্চাদের চ্যানেলটার কথা বলি যে, তোমরা চ্যানেলটা সাবস্ক্রাইব কর এবং চ্যানেলটা রাখ। অন্তত একটা চ্যানেলের ব্যাপারে বাবা-মাকে ভাবতে হচ্ছে না কোন খাবারটা দেব, কোনটা দেব না।
সব কিছু মিলিয়ে আপনি কি আশাবাদী?
আমি খবুই আশাবাদী। নৈরাশ্য আমার অভিধানের শেষ শব্দ।
**মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা থেকে নেওয়া।