ফোন বা কম্পিউটারের প্রতি আসক্তি একটি দুশ্চিন্তার বিষয়

0
48

আমরা এখন উন্নত প্রযুক্তির যুগে বাস করছি এবং আমাদের চারপাশে সর্বত্রই এখন  প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝোঁক বেড়ে চলেছে। কাজকর্ম, পড়াশোনা, কাছের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, বাজার করা, বিল জমা দেওয়া— সবকিছুই মাউসের একটা ক্লিক বা ফোনের মাধ্যমেই এখন করা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্রমশ সহজ করে তুলছে। প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কখন যে এর সুফলের পরিবর্তে আমাদের জীবনকে অস্বাস্থ্যকর এবং আসক্তির মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা আমরা বুঝতেই পারছি না। প্রযুক্তির ব্যবহার যেখানে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা জরুরি, তা আমাদের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস একজনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, নাকি এই অভ্যাসই তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে– এটাই এখন সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন।
১৯ বছর বয়সি রোহিত তার স্মার্টফোনের প্রতি এতটাই আসক্ত ছিল যে, সে যতক্ষণ জেগে থাকত ততক্ষণ সে তার ফোনটিকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইত না। অন্যান্য অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের মতোই সে তার ফোন থেকে ই-মেল করত, বন্ধুদের মেসেজ পাঠাত, তাদের সঙ্গে চ্যাট করত, ইন্টারনেট ঘাঁটত, গেম খেলত।  দিনের মধ্যে কম করে ৬ ঘণ্টা রোহিত তার ফোন নিয়ে সময় কাটাত। প্রতিদিন  ৪০০টি করে টেক্সট মেসেজ সে পেত এবং ২০০টি মেসেজ সে অন্যদের পাঠাত। এই কারণে তার আঙুলে এবং চোখে ব্যথা শুরু হয়। বারবার মেসেজ চেক করার প্রবণতার ফলে রোহিত ভালো করে ঘুমাতেও পারত না। ফলে ক্লাসে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ত। যতক্ষণ রোহিত জেগে থাকত, তার অধিকাংশ সময়েই সে অস্থির, চঞ্চল থাকত। কারণ তার মনে টেক্সট মেসেজের বিষয় ছাড়া আর কোনও ভাবনাই থাকত না। এইসব কারণে তার পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হতে শুরু করেছিল। যখন তার বাবা-মা ছেলের আচরণের পরিবর্তন ঘটতে দেখলেন তখন তাঁরা রোহিতকে নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। তবে অচিরেই তাঁরা ছেলের মধ্যে এই পরিবর্তনের কারণটি বুঝতে পেরেছিলেন। আর কারণটি ছিল— ফোনের টেক্সট মেসেজের প্রতি রোহিতের অস্বাভাবিক আসক্তি।
(এই ঘটনা একজনের জীবনে সত্যিই ঘটেছিল। তবে এখানে তার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)।
প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি – আদৌ কি গুরুতর সমস্যা নয়?
প্রযুক্তির নেশা প্রসঙ্গে তার সর্বাত্মক প্রভাব, স্বাস্থ্যকর বা অস্বাস্থ্যকর ব্যবহার এবং এই ব্যবহার কখন একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়— সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া মোটেই সহজসাধ্য নয়। মানুষের আচরণ কেমন হবে, তা সবসময় পরিমাপ করা সম্ভব হয় না এবং এর ফলাফলও সুদূরপ্রসারী। তাই প্রযুক্তি বা ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিকে অন্যান্য আসক্তিগুলির সঙ্গে এক করে দেখা উচিত নয়। এই সমস্যাকে তত গুরুতর মনে করার কারণ নেই।
প্রযুক্তিগত আসক্তির কুফল যেমন অনলাইন শপিং-এর ফলে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া বা শিশুদের ভিডিও গেম খেলা নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা এগুলিই প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়ায়। আমরা অনেক সময় এটাই বুঝতে পারি না যে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝোঁক শুধু ক্ষতিকারকই নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার পরোক্ষ ফলও খুব গুরুতর আকার ধারণ করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা এহেন আসক্তিগত সমস্যাকে অন্যান্য নেশার মতোই বিবেচনা করেন। সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজের মতো টেকনোলজি অ্যাডিকশনও মানুষের একপ্রকার আচরণগত সমস্যা এবং নিজেকে বাস্তব বা সমাজ থেকে সরিয়ে রাখার মানসিকতাও এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অন্যান্য আসক্তির মতোই প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিও মানুষের একধরনের অভ্যাস। যখন কেউ এই অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে না, তখনই তা একজন মানুষের স্বাস্থ্য, ভালো থাকা, সম্পর্ক এবং তার প্রাত্যহিক কাজকর্মের উপর কুপ্রভাব ফেলে।
ব্যাঙ্গালোরের নিমহ্যান্সের অধীনে থাকা শাট (SHUT) ক্লিনিক, যেখানে প্রযুক্তিগত আসক্তির সমস্যা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে দেখা গিয়েছে যে, প্রত্যেক মাসে এই ধরনের সমস্যার সংখ্যা গড়ে ১৫টি।
প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি বলতে কী বোঝায়?
চিকিৎসা শাস্ত্রে আসক্তি বলতে বোঝায়, কোনও বস্তুর প্রতি মানুষের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, এবং এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করা। মানুষ যখন কোনও বস্তুর দ্বারা আচ্ছন্ন বা বশবর্তী হয়ে যায়, তখন তার কাছে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি যেমন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সবই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। এর ফলে সেই মানুষটি যেমন সমস্যায় পড়ে, তেমন তার চারপাশে থাকা লোকজনরাও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হন।
এহেন সমস্যায় আক্রান্তরা যে কোনও একটি প্রযুক্তিগত মাধ্যমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। ভারতে সাধারণত ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদের এই ধরনের নেশায় আচ্ছন্ন হতে দেখা যায়। কারণ এরাই অতিরিক্ত পরিমাণে মোবাইল, কম্পিউটার, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়াটাও একটি বিরাট সমস্যা এবং জটিল আকার ধারণ করছে। কারণ এটা বলা খুব কঠিন যে, কখন প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং কখনই বা তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে।
নিমহ্যান্সের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনোজ শর্মার মতে, প্রযুক্তিকে আমরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকি। যেমন— পড়াশুনার কাজে, পেশাদারিত্বের খাতিরে বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির নানা উপকারিতা রয়েছে। একটি উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার সফল হলেই একজন অন্য আরেকটি লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নিতে পারে। এইভাবে খুব স্বাভাবিক উপায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত।
ডাক্তার শর্মা, যিনি শাট (SHUT) ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানের কাজের সঙ্গে যুক্ত, তিনি প্রযুক্তির অস্বাস্থ্যকর ব্যবহারের পিছনে কিছু বিশেষ বিষয় যুক্ত থাকে বলে মনে করেন। যেমন— অনেকসময় বিনা উদ্দেশ্য বা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই কেউ কেউ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অনেকে বিনা কারণে এর প্রতি চূড়ান্তভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাই একবার কম্পিউটার বা ফোনের সুইচ অন করলে তা আর বন্ধ করার কথা মনেই থাকে না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেও বারবার ফোনের মেসেজ বা ই-মেল দেখার প্রবণতা এই কারণে বেড়ে যায়। তখন চারপাশে থাকা মানুষজন যেমন — বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে না। এমনকী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময়েও ফোন বা কম্পিউটারের দিকেই নজর থাকে বেশি।
রোহিতের জীবনের সমস্যা, যা আগে বলা হয়েছে, সেরকম আরও বহু ঘটনা বিগত এক বছর ধরে শাট ক্লিনিক লক্ষ্য করছে। ডাক্তার শর্মা জানিয়েছেন যে, যে সব অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য আসে,  তাদের মধ্যে স্কুলের পড়াশোনার প্রতি অবহেলা, দৈনন্দিন রুটিনমাফিক কাজ না করা, নিজেদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল না রাখা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। আসলে এগুলির জন্য দায়ী ফোনের মাধ্যমে মেসেজ আদান-প্রদানের প্রবণতা, ভিডিও গেম খেলা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এবং অনলাইন পর্নোগ্রাফি দেখার আকর্ষণ।
শাট ক্লিনিকের সব থেকে কম বয়সের রুগি, যে ছিল মাত্র ১৪ বছরের একজন ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত ছেলে। তার যখন ৬ বছর বয়স তখন থেকেই সে অনলাইন ভিডিও গেম খেলা শুরু করেছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর বাকি সময়টা এবং সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনগুলিতেও ভিডিও গেম খেলেই সে সময় কাটাতো। প্রথমদিকে এই ঘটনাটিকে অভিভাবকরা একদম গুরুত্ব দিতে চাইনি। ছেলেটি খেলার জন্য তার ঘরের বাইরেই যেত না। এমনকী, খাওয়া-দাওয়া বা জল খাওয়ার জন্যও তাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে দেখা যেত না। সে বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চাইত না। বাবা-মা প্রথমে ভেবেছিল যে, উঠতি বয়সের জন্যই ছেলে এমন ব্যবহার করছে। কিন্তু সমস্যা তখনই গুরুতর হয়ে উঠল যখন স্কুল থেকে জানানো হল যে, ছেলেটি ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ছে, পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না এবং স্কুলের নির্ধারিত কাজগুলিও ঠিকঠাকভাবে করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য ছেলেটির বাড়ির লোক তাকে শাট ক্লিনিকে নিয়ে এসেছিল। বাবা-মা তাদের ছেলের উপর সবসময়ে রেগে থাকত এবং ছেলের কাজকর্মের জন্য খুব দুঃখও পেয়েছিল। ছেলেটি যখন ক্লিনিকের ডাক্তারদের সাহায্যে আস্তে আস্তে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শুরু করল, তখন তার বাবা, মা-ও স্বস্তি পেতে শুরু করেছিল। কাউন্সেলিং এবং এই সমস্যাটির বিষয়ে বিশদে জানার পর তারা পরিস্থিতিটিকে খুব ইতিবাচক দিক থেকে দেখতে শুরু করেছিলেন। বাবা-মা এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের ছেলে ঠিক কী ধরনের সমস্যায় পড়েছিল। এরপর ছেলের ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন লক্ষ্য রাখতে তারা শুরু করে এবং দেখা যায় যে, পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের প্রতি ছেলের মনোযোগ আগের থেকে বাড়ছে। এইভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই ছেলেটির স্কুলের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং তার আচরণগত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিও কেটে যেতে শুরু করে।
প্রযুক্তির আসক্তি কাটানোর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি কি?
যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি নেশাগ্রস্ততার কারণে দুই বা তিনরকমের লক্ষণ নজরে পড়ে, তাহলে এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। লক্ষণগুলি হল—

  • প্রবল ইচ্ছা— যদি ফোন বা কম্পিউটার থেকে দূরে থাকার সময়েও সেগুলি ব্যবহারের জন্য প্রবল ইচ্ছা জাগে এবং মনের অস্থিরতা বাড়ে।
  • নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা— কতক্ষণ ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হবে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে না পারা (অর্থাৎ, পরিকল্পনার থেকেও ইন্টারনেটের সামনে বেশি সময় ব্যয় করা)।
  • বাধ্যতা— জেগে থাকার অধিকাংশ সময় অনলাইনে ব্যস্ত থাকা।

এছাড়াও আরও চারটি লক্ষণ দেখা যায়। সেগুলি হল—

  • অন্যান্য কাজে আগ্রহ হারানো
  • অনলাইনে বেশি সময় কাটানো
  • মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বারবার ই-মেল বা মেসেজ দেখা
  • কাজের জায়গায় কর্মদক্ষতা এবং স্কুলের প্রতি মনোযোগ কমে যায়
  • পরিবার এবং বন্ধুদের অবহেলা করা
  • নিজের যত্ন এবং পুষ্টির দিকে নজর না দেওয়া (নির্দিষ্ট সময় খাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাওয়া)

প্রযুক্তিগত আসক্তির ফলাফল
প্রযুক্তির নেশায় আচ্ছন্ন হওয়াটা একধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়। যদি এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে তা আসক্তিতে পরিণত হবে এবং মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্মে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যে যে ক্ষেত্রে এর কুফল দেখা যাবে, সেগুলি হল —

  • ঘুমের ক্ষেত্রে – অনলাইনে অনেকটা সময় কাটানোর কারণে রাতে দেরি করে ঘুমানোর প্রবণতা বাড়ে বা নিশ্চিন্তভাবে ঘুমানো যায় না।
  • উৎপাদনশীলতা বা সৃষ্টিশীলতা বাধা পায় – ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বাড়ে। কারণ লেখাপড়া বা অন্যান্য কাজের সময় ঘুম পায়। ফলে পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হতে থাকে।
  • স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা – প্রযুক্তির ঝোঁক মানুষের কব্জি, হাতের আঙুল, চোখ এবং মেরুদণ্ডে ব্যথার জন্ম দেয়। এছাড়া ক্লান্তি, খিদে কমে যাওয়া, শরীরে জলের অভাবজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
  • যোগাযোগের সমস্যা – প্রযুক্তি ব্যবহারের নেশা মানুষের জীবনকে অনলাইনকেন্দ্রিক করে তোলে। তারা এই জন্য ঘরের বাইরে যেতে চায় না। এমনকী, সামাজিক সম্পর্কগুলির সঙ্গেও তারা যোগাযোগ রাখতে চায় না। সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার চেয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখা তাদের কাছে অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়ে।

শাট ক্লিনিকে আসা এই ধরনের আসক্ত ব্যক্তিদের সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়—

  • প্রথমত, মানসিক সমস্যায় ভুগছে এমন কিশোর-কিশোরী — এরা খুব লাজুক এবং মানসিক উদ্বেগের শিকার হয়। কোনও সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে না। তারা অনলাইনেই ভার্চুয়াল জগতে নিজেদের আটকে রাখে, কারণ ওখানে তাদের কোনোরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না।
  • দ্বিতীয়ত, আরেক ধরনের ছেলে-মেয়ে যারা নতুন অভিজ্ঞতা ভালোবাসে এবং চেষ্টা করে নতুন কিছু করতে। অধিকাংশ অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা বিনোদন এবং নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বা ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

”সাধারণত, বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের তখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, যখন সমস্যা খুব গুরুতর হয়ে ওঠে। প্রথমে তারা অতিরিক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা আদৌ কার্যকরী হয় না। অভিভাকরা যে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধী, তা নয়। প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক ছেলে-মেয়েদের স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য কাজকে ক্ষতি করে দিচ্ছে এই চিন্তাই বাবা-মায়েদের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের আশঙ্কা থাকে যে তাদের ছেলে-মেয়েরা ফোন বা কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে এবং ক্রমে এগুলির ব্যবহার তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আমরা যখন তাদের সঙ্গে কথা বলি, তখন বুঝতে পারি যে, অভিভাবকরা প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জীবনের অন্যান্য চাহিদাগুলির মধ্যে একপ্রকার ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে চাইছে,”— ডাক্তার শর্মা এমনটাই মনে করেন।
শাট ক্লিনিকে যারা আসে, তাদের অধিকাংশই হল অল্পবয়সি ছেলে। আর এরা মূলত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের অধিকাংশই বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে এবং বড়দের সাহচর্য ও বাইরের জগতের সঙ্গে মেলামেশার অভাবের জন্যই এদের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে প্রযুক্তি ব্যবহারের নেশা জন্মায়।
প্রযুক্তি এবং অন্যান্য নেশার বস্তুর প্রতি আসক্তি
প্রযুক্তি ব্যবহারের নেশাকে মানুষের অন্যান্য নেশার দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণের চাইতে কম ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মদ, তামাক বা ড্রাগের নেশার মতোই প্রযুক্তির নেশাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। যে ভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বেড়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে অন্যান্য নেশার ব্যবহারের মিল রয়েছে। এই সব জিনিসের প্রতি মানুষের প্রবল আসক্তি ফলে এগুলির ব্যবহারকে ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারছে না। এমনকী, মানুষ যখন এগুলির ব্যবহার করা থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চাইছে, তখনও তারা এর নেশা থেকে বেরতে পারছে না। ফলে, মাদকাসক্তি যেমনভাবে মানুষের শরীর এবং মনের উপর প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনভাবে প্রযুক্তির নেশা মানুষের আচরণের উপর কুপ্রভাব বিস্তার করছে। সমস্ত রকমের আসক্তিই মানুষের মানসিক বিপর্যয়, স্বাস্থ্যের অবনতি, সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, তার আচরণগত ত্রুটি এবং উৎপাদনশীলতা রোধের জন্য দায়ী।
প্রযুক্তিগত আসক্তি থেকে প্রতিকারের উপায়–
অন্যান্য নেশা থেকে মানুষকে মুক্ত করার বিষয়টি যেমন মানসিক চিকিৎসার অঙ্গ, ঠিক তেমনই প্রযুক্তির আসক্তি কাটানোর ক্ষেত্রে এই একইরকম চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। এই চিকিৎসা প্রণালী মানুষের জীবনধারণ এবং কাজকর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতি কোনও ব্যক্তির আকর্ষণ কমাতে এহেন চিকিৎসা কার্যকরী হয়।
প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির চিকিৎসা তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে—
প্রথমে, একজন ব্যক্তি কাউন্সেলর বা সাইকোলজিস্টের সাহায্য নেন। একজন বিশেষজ্ঞ রুগির দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা
করেন। তাঁর মনে কতগুলি প্রশ্ন জাগে–

  • একজন ব্যক্তি প্রযুক্তির উপর কতখানি নির্ভরশীল?
  • প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে কোন কোন পরিস্থিতি যুক্ত?
  • কী ধরনের মানসিক অবস্থার জন্য একজন ব্যক্তি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত
    হয়ে পড়ছে?
  • পরিবারগত কারণে কি একজন মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটছে?

এইভাবে ডাক্তার মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এটি সম্ভব হয় সাইকো-এডুকেশনের দ্বারা। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারের জন্য কতটা ক্ষতিকারক, ব্যক্তির আচরণগত সমস্যা বা এর ফলে সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এই চিকিৎসার সাহায্যে সমস্যায় আক্রান্ত একজন মানুষ এবং তার পরিচর্যাকারীর সংকটগুলিকে দূর করার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও অসুবিধা যেমন, ওজন কমে যাওয়া, ঘুম এবং খিদে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
চিকিৎসা চলাকালীন অসুস্থ ব্যক্তি বা তার পরিচর্যাকারীর প্রযুক্তিগত আসক্তির বিষয়টিকে ভালো করে জানা উচিত এবং কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে, তা বোঝা একান্ত জরুরি।
সাইকো-এডুকেশন পদ্ধতির অন্যতম গুরুত্ব হল প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে উৎসাহ বা প্রেরণা দেওয়া। কোনও মানুষকে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার কমাতে উৎসাহ জোগানো হয়, তাহলে ওই বিষয়ের প্রতি তার নেশা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। অন্যান্য নেশার মতোই এই নেশা ছাড়ানোর ক্ষেত্রেও মানুষকে যদি জোরজবস্তি করে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি করবে। কারও কারও ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে, তার অস্বস্তি বা বিরক্তি আরও বেড়ে যায়। তাই মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এমন একটি অলিখিত চুক্তি করতে হয়, যাতে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় সে ইন্টারনেট, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের ব্যবস্থা খুব কম সময়ের জন্য নেওয়া উচিত এবং এর ফলাফল ভালোভাবে লক্ষ্য করা জরুরি। আর যার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে তার মতামত থাকাটা অবশ্যই প্রয়োজন।
সমস্যাটির অস্তিত্বকে স্বীকার করা জরুরি–
মানুষ যে প্রযুক্তির দ্বারা আসক্ত হতে পারে, কেউ কেউ সে বিষয়টি অনেকসময় মানতেই চায় না। তারা ভাবতেই পারে না যে প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের বিপদ ডেকে আনছে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেই সব মানুষকে জোর করে তাদের জেদ থেকে না সরিয়ে, কীভাবে তাদের ক্ষতি থেকে বাঁচানো যায় বা তাদের এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের বদল ঘটানো যায়, সেদিকে মন দেন। কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য নানা সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে এই ব্যবস্থা তখনই কার্যকরী হয়, যখন মানুষের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝোঁক কম করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। একজন মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তখনই কমবে, যখন সে বুঝতে পারবে যে তার প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্যকর বা যথাযথ হচ্ছে না এবং এই কারণে তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
অন্যান্য কাজকর্মের দিকে মনোযোগ বাড়ানো প্রয়োজন–
একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের উচিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি নতুন জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণের দিকে নিয়ে যাওয়া। যেখানে নিজের প্রতি যত্নশীলতা, নিজেকে সঠিক পথে চালিত করা, এমনকী, ঘরের বাইরে বেরিয়ে নানা কাজ করা, লেখাপড়ায় মন দেওয়া এবং সমাজে মেলামেশা করার সুযোগ থাকে। আসলে, প্রযুক্তির আসক্তির ফলে মানুষ যে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে ঘুম কমে যাওয়া, সমাজে মেলামেশা করতে অনীহা এবং নিজের যত্ন না নেওয়ার ফলে দুর্বল স্বাস্থ্য, পুষ্টির অভাব প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়।
অধিকাংশ বাবা-মা, যারা বুঝতে পারে যে তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রযুক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে, তারা স্বভাবতই খুব আতঙ্কিক এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলর অভিভাবকদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সাহায্য করে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সাহায্য করেন।

Previous articleআসক্তি মুক্ত হওয়ার উপায়
Next articleঘুম এবং ঘুমের সমস্যা নিয়ে মনের খবর ফেসবুক লাইভ আজ রাতে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here