কেন মানসিক রোগ চিকিৎসা প্রয়োজন?

0
212
কেন মানসিক রোগ চিকিৎসা প্রয়োজন?

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’-এই আপ্তবাক্য ছোটোবেলা থেকেই আমরা শুনেছি। ছোট্ট একটা শব্দ ‘স্বাস্থ্য’র মাঝে লুকিয়ে আছে কত না জানা-অজানা, মানা-না মানা বিষয়। WHO বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘স্বাস্থ্য’কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছে-‘স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সর্বাঙ্গীন ভালো থাকা-শুধুই জরা বা রোগমুক্ত থাকা নয়।’ সংজ্ঞাটির প্রধান তিনটি উপাদানের মাঝে একটি-মানসিক।

জ্বী পাঠক, মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে আপনি কিন্তু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নন। আর যদি আপনি মানসিকভােেব অসুস্থ থাকেন বা মানসিক রোগাক্রান্ত হন তাহলে আর দশটা শারীরিক রোগের মতোই আপনার দরকার বিজ্ঞানসম্মত এবং সময়মতো চিকিৎসা।

মানসিক রোগ কী?
আমরা প্রত্যেকেই দুঃখে কাঁদি, হই বিষণ্ণ; সমস্যায় উদ্বেগে আচ্ছন্ন হই, হই ভীত; আবার সুখের সময় আনন্দে উদ্বেল হই। এই দুঃখ-বেদনা, উদ্বেগ, আতঙ্ক সবই আমাদের জীবনের স্বাভাবিক বোধ। জীবনের মন্দ কোনো ঘটনার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মন খারাপ হতেই পারে। আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার স্রোতে তা কেটেও যায়। যেমন ধরুন, কোনো প্রিয় মানুষের মৃত্যু বা দূরে চলে যাওয়ার ঘটনায় আমরা কষ্ট পাই, বিষণ্ণ হই। বিষণ্ণতা একটি উপসর্গ, কিন্তু এই স্বাভাবিক আবেগীয় উপসর্গকে কিন্তু রোগ বলা যাবে না। মানসিক রোগ হতে হলে উপর্সগকে হতে হবে সার্বক্ষণিক, সর্বব্যাপী। তীব্র মাত্রায় এবং সর্বোপরি তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করতে হবে। আমি শিক্ষক হলে শ্রেণিকক্ষে পড়াতে পারব না, ছাত্র হলে পড়াশোনা করতে পারব না। কেউ যদি এরকম অবস্থায় উপনীত হয় তাহলেই সে হবে মানসিক রোগে আক্রান্ত।

আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশিত ম্যানুয়েল যা কিনা উঝগ বা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়েল নামে পরিচিত তাতে মানসিক রোগকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ সংজ্ঞার সহজীকরণে যা দাঁড়ায় তা হলো-মানসিক রোগ মানুষের এমন কতগুলো আবেগীয়, শারীরিক বা আচরণগত সমস্যা বা অস্বাভাবিকতার সমষ্টি যা ব্যক্তিকে অসুস্থ করে এবং তার সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলোকে ব্যাহত করে।’ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক রোগের হাজারো রকমফেরের মধ্যে প্রধানতম রোগগুলো হলো-সিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত রোগ, মানসিক চাপজনিত রোগ, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, খাওয়া, ঘুম বা সাইকোসেক্সুয়াল সমস্যা, আত্মহত্যা প্রবণতা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। এছাড়া শিশুদের রয়েছে আবেগগত, আচরণগত বা সড়বায়বিক বিকাশজনিত রোগ। বৃদ্ধ বয়সেও স্মৃতিভ্রংশ রোগ (ডিমেনশিয়া) বা বিষণ্ণতায় মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।

মানসিক রোগ ছাড়া আরো কিছু কারণেও কিন্তু মানসিক চিকিৎসা বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে হয়। যেমন-সম্পর্কগত সমস্যা; সেটা হতে পারে দম্পতিকেন্দ্রিক, সন্তান-পিতামাতা, সহোদর এমনকি সহকর্মীর মধ্যেও। নির্যাতনের শিকার হলে বা শিশু নিগ্রহের কারণে বা কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতিতেও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয় এবং প্রয়োজন হয় চিকিৎসার।

মানসিক রোগের প্রকোপ
বাংলাদেশে সর্বশেষ জরিপে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার যে চিত্রটি উঠে এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৬.০১% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। শিশু-কিশোরাদের মধ্যে তা আরো বেশি; প্রায় ১৮.৪% ভাগ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, পৃথিবীর ৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জন কোনো না কোনো মানসিক, আচরণগত বা স্নায়বিক রোগে ভুগছে। এই যদি হয় চিত্র তাহলে জাতীয় বা বৈশ্বিক উন্নয়নে এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা পূর্ণ কর্মক্ষম পাচ্ছি না। এরপরও কি আমাদের উচিত নয় কুসংস্কার বা লজ্জার পাহাড় ডিঙিয়ে সুচিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসা? ভাবুন তো একটিবার!

  • কেন মানসিক রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন?
    এই প্রয়োজনটিকে একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। প্রয়োজনগুলো আসলে নানা স্তরের :
    ব্যক্তিগত
    পারিবারিক
    সামাজিক
    রাষ্ট্রীয়
    বৈশ্বিক

ব্যক্তিগত প্রয়োজন
ক. রোগ সে হোক শারীরিক বা মানসিক, আক্রান্ত ব্যক্তিকে তা কঠিন দুর্দশার মধ্যে ফেলে। রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য তাই আশু চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই।
খ. কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা মানসিক রোগাক্রান্ত রোগীকে চরম অবহেলার মধ্যে রাখি। অবজ্ঞা, লজ্জা আর কুসংস্কারের আবর্তে তার ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে তুলি।
গ. মানসিক রোগের রোগী লেখাপড়া বা পেশাগত কাজ করতে না পারায় তার ভবিষ্যত ক্যারিয়ারও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ঘ. কিছু রোগে আক্রান্ত রোগী অনেক সময় নিজের ক্ষতি করে বা আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে, আবার অন্যের ক্ষতির কারণও হতে পারে। রোগের কারণে অন্যের সঙ্গে মারামারি বা ভাঙচুর করে যে ক্ষতিসাধন হয় তা থেকে পরিত্রাণের জন্যও তার চিকিৎসা হওয়া দরকার।

পারিবারিক প্রয়োজন
মানসিক রোগী তার রোগজনিত অকর্মণ্যতার কারণে পরিবারের বোঝা হয়ে যায়, পরিবারের জন্য লজ্জা বা দুঃশ্চিন্তারও কারণ হয়। সঠিক সময়ে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে পুরো পরিবারকেই সাহায্য করা যায়।

সামাজিক প্রয়োজন
ক. সাইকোটিক বা মাদকাসক্ত রোগী অনেক সময় নেশা, ছিনতাই, চুরি বা অন্যান্য অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এই অসুস্থ মানুষগুলো পরবর্তীতে সুস্থদেরকেও এ পথে প্ররোচিত করে। এই সামাজিক অবক্ষয় রোধেও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন জরুরি।
খ. এখন পর্যন্ত মানসিক রোগীকে ঘিরে যে কুসংস্কার রয়েছে সেজন্য সমাজও এসব রোগীকে হেয় প্রতিপন্ন সকরে। একটি পরিবারে একজন মানসিক রোগী থাকলে, তাকে ও তার পরিবারকে অনেক ক্ষেত্রে অপদস্থ হতে হয়। কাজেই রোগীর চিকিৎসা করিয়ে সামাজিক অবস্থান সুসংহত করাও একটি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
গ. সর্বোপরি, মানসিক রোগের চিকিৎসার সুফল সামাজিক সচেতনতা বাড়াবে ও এই রোগ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণাও বদলে দেবে।

রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন
একজন নাগরিকের পেছনে রাষ্ট্রেরও কিন্তু অনেক অর্থলগ্নি করতে হয়, সেই নাগরিকের কাছ থেকে তাই রাষ্ট্রের প্রত্যাশাও থাকে। কিন্তু মানসিক রোগের কারণে সে যদি কোনো গঠনমূলক বা কার্যকর জীবনযাপন করতে না পারে বা আত্মহত্যা করে তবে সেটা সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতি। জাতীয় জিডিপির ওপরও এর প্রভাব পড়ে। কাজেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রোগমুক্তি কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের জন্যও সুফল বয়ে আনবে।

বৈশ্বিক প্রয়োজন
ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্টর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মানসিক রোগের জন্য গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ (এইউ) বা ‘রোগের কারণে বৈশ্বিক উন্নয়নে চাপ’ বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে শুধুমাত্র মানসিক রোগজনিত জিবিডি ১৩.৪৬% ভাগ এবং ২০৩০ সালে মধ্যে তা ১৪.৪২ ভাগে গিয়ে দাঁড়াবে। এই যদি হয় চিত্র, তবে বৈশ্বিক উন্নয়নেও রোগাক্রান্ত এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা উপযুক্ত কর্মক্ষম পাচ্ছি না।

প্রিয় পাঠক, ভাবুন তো চিত্রটা কি ভয়াবহ নয়? এরপর নিশ্চয়ই আপনারাও একমত হবেন যে, মানসিক রোগের চিকিৎসা আসলেই প্রয়োজন। আর এইসব তাত্ত্বিক আলোচনা দূরে সরিয়ে যদি সরল দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখি যে, এইসব রোগাক্রান্ত মানুষগুলো আমাদেরই মা-ভাই-বোন-বন্ধু। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন তাদের অধিকার তাহলে কি আর বিষয়টি অগ্রাহ্য করার উপায় থাকে? তবে আসুন, আজই আপনার রোগাক্রান্ত ভাই, বোন বা বন্ধুটিকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসি এবং চিকিৎসায় সহযোগিতা করি! মানুষ হিসেবে চলুন আমি, আপনি আমাদের ন্যূনতম দায়িত্বটা পালন করি!

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
Next articleশিশুদের জন্য খেলাধুলার গুরুত্ব সবাইকে অনুধাবন করতে হবে
ডা. জেসমিন আখতার
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here