কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে?

0
69

অ্যারিস্টটল বলেছেন, যে পুরুষেরা মদ্যপান করে আর তরুণরা যৌবনের তেজে উষ্ণতা প্রাপ্ত করে।

বয়ঃসন্ধি আমাদের জীবনে প্রভূত অনুভূতিগত ও আচরণগত পরিবর্তনের সূচনা করে। এর ফলে কিশোর-কিশোরীদের মনে,এমনকী তাদের চারপাশে থাকা পূর্ণবয়স্ক মানুষের মনে নানারকম ধন্ধ বা সন্দেহ বাসা বাঁধে। পূর্ণবয়স্ক মানুষ বা বড়রা বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের হঠকারি মনোভাব, তাদের মেজাজি হয়ে ওঠা এবং সেগুলোর ভিতর লুকিয়ে থাকা ঝুঁকির কারণগুলো বোঝার ও জানার চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে কিশোর-কিশোরীদের মনেও তাদের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে নানারকম প্রশ্ন জেগে ওঠে এবং তা বোঝার জন্য তাদের মধ্যে একপ্রকার মানসিক লড়াই শুরু হয়।
স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের দৈহিক পরিবর্তন সম্পর্কে নানা তথ্য লেখা থাকে। কিন্তু সেখানে এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং তাদের আচরণের উপর মস্তিষ্কের কার্যকলাপের প্রভাব সংক্রান্ত তথ্যাবলীর উপস্থিতি প্রায় থাকে না বললেই চলে।
বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের জীবনে ঘটা কিছু পরিচিত ঘটনা বা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা এই বিষয়টিকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। ধরা যাক বয়ঃসন্ধিকালের কোনও ছেলে বা মেয়ে শপিং মলে সিনেমা দেখতে গিয়ে ফেরার সময়ে একটা নতুন ফোন কিনে ফেলল, দীর্ঘদিন ধরে জমানো টাকা তারা ওই একদিনেই সব খরচ করে ফেলল। আবার কেউ কেউ নতুন একটা চাকা লাগানো সরু তক্তা কিনে ফেলল যার উপর দু’পা রেখে শারীরিক কসরত দেখানো যায় এবং সেই বস্তুটিকে নিয়ে বাড়ির ছাদের উপর শুরু হল দাপাদাপি করা, যার ফলে শেষমেশ তাদের শরীরে আঘাতও লাগল। এমনকী, কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে তাদের  বন্ধুদের সঙ্গে মিলে নতুন কিছু করার নেশায় ড্রাগ বা মদ্যপান করা শুরু করল। প্রশ্ন হল, এসব কি তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের প্রভাব যার ফলে তারা সম্ভাব্য বিপদের তোয়াক্ক না করে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে?
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে শৈশবকালে আমাদের মস্তিষ্কের একটা বড় অংশের বিকাশ ঘটে। ছ’বছর বয়স নাগাদ ৯০ শতাংশ মস্তিষ্কের আকৃতির গঠন সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু তারপরেও প্রায় কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের মস্তিষ্কের নানারকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটে। এর সঙ্গে অনেকটা যন্ত্রের কার্যকলাপ ও তার পরিমার্জনের মিল রয়েছে। অর্থাৎ এইসময়ে অনেক নতুন যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং পুরনোদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়, যেগুলোর ব্যবহার আর কখনোই হয় না। আমাদের মস্তিষ্কের যোগসূত্রও এরকম বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে।
বয়ঃসন্ধিকালীন আচরণের বোধগম্যতা
বয়ঃসন্ধিকালীন আচরণের খুঁটিনাটি বুঝতে গেলে আমাদের মস্তিষ্কের দুটো ভাগের বিষয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাগ দুটি হল- প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং লিম্বিক সিস্টেম। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-এর কাজ হল মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি, চিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, সংস্কার নিয়ন্ত্রণ-সহ প্রভৃতি কাজ করা। অন্যদিকে, লিম্বিক সিস্টেমের দ্বারা মানুষের  অনুভূতি যেমন- রাগ, বিপদের প্রতি সংবেদনশীলতা, তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
লিম্বিক সিস্টেমের পর প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-এর বিকাশ ঘটে। এর ফলেই বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যুক্তি-বুদ্ধির চেয়ে আবেগ প্রাধান্য পায়। শৈশব বা পূর্ণবয়সের চেয়ে বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের ভালো-লাগা বা মন্দ লাগার অনুভূতিগুলিও অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়। এজন্য এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে  ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়।
প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অর্থাৎ মস্তিষ্কের যে অংশটা আমাদের নিজেদের কাজকর্মের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে, সেই অংশটা মধ্য-কুড়ি বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ করে না। এর ফলে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পরিণতি ভেবে কাজ করার মানসিকতা জন্মায় না। যে বিষয়টা বা কাজটা তাদের পছন্দের বলে মনে হয় সেটা তারা ক্ষণিকের আনন্দের জন্য করে ফেলে। কিন্তু ফলাফলের কোনও চিন্তাই তাদের মাথায় থাকে না।
মস্তিষ্কের বিকাশের ধারায় বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার দক্ষতা গড়ে ওঠে। তাই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের উচিত বয়ঃসন্ধির একটা ছেলে বা মেয়েকে সৃষ্টিশীল এবং নতুন নতুন কাজে দক্ষ করে তুলতে উৎসাহ দেওয়া। এর ফলে  মস্তিষ্কের যোগাযোগ ক্ষমতা শক্তিশালী হয় এবং দুর্বল অংশগুলো অগোচরে চলে যায়। একজন মালি যেমন বাগান পরিচর্যার ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ঝোপঝাড় কেটে ফেলে একটি গাছকে শক্তিশালী করে তোলে তেমন করেই বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্কের বিকাশে আমাদের সাহায্য করা জরুরি।
পূর্ণবয়স্ক বা বড়দের করণীয় দায়িত্ব
একটি বয়ঃসন্ধির ছেলে বা মেয়ের কাছে নিজেকে পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়ে তোলাই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রধান দায়িত্ব। একাজ করতে গিয়ে কিশোর-কিশোরীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা একেবারেই উচিত নয়। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্কে গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল হয়। তাই বড়দের সহায়তা এবং তাদের লালন-পালন কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কের বিকাশের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। বড়দের উচিত বাচ্চাদের মধ্যে যেন আত্ম-সচেতনতা, হঠকারী কাজকর্মের জন্য কলঙ্কের বোধ বা ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা গড়ে না ওঠে সেদিকে যত্নশীল হওয়া। এসবের কারণেই বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মনে হতাশা বেড়ে যায় এবং তাদের আচরণে বিদ্বেষ প্রকাশ পায়।
Previous articleইন্টারনেটের অত্যাধিক ব্যবহার থেকে অবসাদ আর অনিদ্রা হতে পারে
Next articleস্বাভাবিকভাবে মস্তিস্কে গ্রে ম্যাটার-এর বৃদ্ধি করা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here