কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার শিশু কিশোরদের মারাত্মক আচরণঘটিত মানসিক সমস্যা। এই ডিজঅর্ডারে ভোগা শিশু-কিশোররা আচরণে বেপরোয়া হয়ে। আত্মীয় ও পরিবারে বেয়াদব হিসাবে পরিচিত ছেলেটি চুরি, মানুষ বা প্রাণীর প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ, অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করা, মারামারিতে সিদ্ধহস্ত, কখনো ঘর পালানো, স্কুল পালানো কিংবা আরেকটু বড়ো হয়ে মাদক গ্রহণ থেকে শুরু করে বড়ো অপরাধ এমনকি যৌন অপরাধেও জড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ সঠিক সময়ে চিকিৎসায় না আসলে কিশোরটি সমাজবিরোধী (অ্যান্টি সোশ্যাল) আচরণ কিংবা অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে পরিণত হয়ে অন্ধকারের গহ্বরেও হারিয়ে যেতে পারে। তাই তার সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল আচরণের চিকিৎসা কি আসলে আছে? এর চিকিৎসা আলোচনার পূর্বে, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার কেন হয়, অর্থাৎ এর কার্য-করণ বা Aetiology খুব সংক্ষেপে জেনে নেয়া দরকার। কারণ এ আচরণগত সমস্যাটির ক্ষেত্রে জীনগত ব্যাপারের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ জীবনের ভূমিকা অপরিসীম।
জীনগত প্রভাব
পারিবারের প্রভাব, সাধারণত সুবিধা বঞ্চিত, বিশৃঙ্খল, অনিয়ন্ত্রিত পারিবারিক পরিবেশ, পিতা-মাতার আচার-আচরণের বৈরিতা, বিবাহ-বিচ্ছেদ বা মৃত্যু, পারিবারিক অশান্তি, সঠিক প্যারেন্টিংয়ের অভাব, পারবারিক শিক্ষা এবং সহপাঠীর অসৎ সঙ্গ থেকে এবং তা অনুকরণের মাধ্যমে অ্যান্টি সোশ্যাল জীবনচর্চা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে অসুখে রূপ নেয়।
পরিবেশগত প্রভাব
শিশু যদি এক অস্থির, সমাজবিরোধী পরিবেশ বা প্রতিবেশী বা সঙ্গীদের সঙ্গে দিনের অধিকাংশ সময় কাটায়, সেটাও তার মধ্যে বিরূপ আচরণ তৈরি করতে সাহায্য করে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
শৈশবে অ্যাবিউস কিংবা নির্যাতনের শিকার হলে সে ঘটনা অবদমিত করে রাখে। পরবর্তীতে এটা থেকে সহিংস আচরণের জন্ম হতে পারে।
সবশেষে চিকিৎসা নিয়ে বলি
এই রোগের চিকিৎসা একটু চ্যালেঞ্জিং বটে। যেখানে এদেশের বেশির ভাগ মানুষের এই ধারণা থাকে যে, রোগ হয়েছে তো ওষুধ দিলেই ভালো হয়ে যাবে।
সেখানে সাইকোথেরাপির রোল বোঝানো একটু কষ্টকর বৈকি। এই রোগের প্রধান চিকিৎসার মধ্যে প্যারেন্ট ট্রেইনিং প্রোগ্রাম, রাগ নিয়ন্ত্রণ প্রশিক্ষণ বা Anger management : স্কুল ইন্টারভেনশন, ফ্যামিলি থেরাপি ইত্যাদি দেয়া হয় এবং পেশেন্টের আক্রমণাত্মক ব্যবহার এবং অন্যান্য সমস্যা বুঝে ওষুধ দেয়া হয়।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনে আচরণের সমস্যাগুলো গুরুতর রূপ ধারণ করার পরই অনেক বাবা-মার নজরে আসে। আর হ্যাঁ, পরিবারের অনেক অস্বাভাবিকতা যেভাবে এই রোগটাকে বাড়িয়ে দেয়, একইভাবে পরিবারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই এই আচরণগত সমস্যা থেকে আপনার সন্তানটি বের হয়ে আসতে পারে। তাই আচরণে আবাধ্য সন্তানটিকে দূরে ঠেলে নয়, কাছে টেনে সঠিক আচরণের মাধ্যমেই সুস্থ করে তুলতে পারেন। সাধারণত এসব অনেক রোগীদের শিশুকালেই অবাধ্য ও বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমেই সমস্যাটির প্রকাশ ঘটে এবং সেক্ষেত্রে অনেক পরিবার তার আচরণকে ইগনোর করে বা প্রশ্রয় দিয়ে সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই বয়সজনিত স্বাভাবিক চঞ্চলতা বা দুষ্টুমি যখন অতিরিক্ত মনে হবে, তখনই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। ডাক্তার যদি মনে করেন আপনার সন্তান আচরণগত সমস্যায় ভুগছে সেক্ষেত্রে সামান্য উপদেশ আর কিছু নিয়ম-কানুনের মধ্যে চললেই ভালো কাজে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মৃদু কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার এবং কৈশোরে যদি কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার শুরু হয় এর প্রগনোসিস বেশ ভালো, অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে আরোগ্য লাভ হয় দ্রুত। কিন্তু যদি শিশুকালে সমস্যা শুরু হয়, এবং সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সমস্যা বা ইন্টেলেকচুয়াল ডিজ্যাবিলিটি থাকে, বা অউঐউ, ডিপ্রেশন না নেশার ঝোঁক থাকে বা অতিরিক্ত রাগ বা অ্যাগ্রেসিভ ব্যবহার সেক্ষেত্রে তার অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গে ওষুধপত্রাদিও দিতে হয়।
পরিবার শুধু বাবা-মা আর সন্তাদের দিয়ে গড়ে ওঠা কোনো সাধারণ ইউনিট নয়। এই পরিবার থেকেই গড়ে ওঠে শিশুর শিক্ষার আর ভবিষ্যতের ভিত। ভালো স্কুলে পড়া আর বড়ো চাকরি করা মানেই আমার সন্তান একশত ভাগ সফল এই ধারণা ভুল। সঠিক শিক্ষা আর মনুষ্যত্ব বোধ মানুষ তার পরিবার থেকেই পায়। সেটাই আসল শিক্ষা। বাবা-মায়ের মধ্যকার ভালোবাসা, নিয়ম আর পরিমিতিবোধ দেখে শিশু যেমন সেটা শেখে। বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাটি, অস্বাভাবিক বা সমাজবিরোধী আচরণ থাকলে ওই শিশু সেটাই শিখবে।
মনুষ্য ধর্মের সবচেয়ে অসাধারণ জিনিস হচ্ছে “HOPE”….
Hope Can Be a Powerful Force. Maybe there’s no actual magic in it, but when you What you hope for most, and hold it like a light within you, you can make Things happens, Almost like magic.(Laini Taylor)
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে