কয়েক বছর আগেও ২৭ বছরের সারা মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো৷ সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতেই কষ্ট হতো৷ মনে হতো সবকিছু অর্থহীন, আনন্দহীন৷ থেরাপি নেওয়ার পর এখন কিছুটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী৷
সারার মা-বাবা মরক্কো থেকে এসেছেন ৭০ দশকের প্রথম দিকে৷ অনেক অভিবাসীর মত সারার বাবাও কাজ নিয়ে এসেছিলেন জার্মানিতে৷ যাদের বলা হতো অতিথি শ্রমিক৷ যদিও আতিথেয়তা বলতে অন্য কিছু বোঝায়৷ সারার ১৯ বছরের তরুণী মা স্বামীকে অনুসরণ করেন ভীরু পদক্ষেপে৷ জার্মান ভাষা না জানায় প্রতি পদে পদে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে তাঁকে৷ বৈষম্য ও অপমানের শিকার হতে হয়েছে৷ ফলে তাঁকে একটা ভয় পেয়ে বসে৷ অন্যান্য অনেক অভিবাসীদের মধ্যেও এই ধরনের একটা ভীতি লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ, যারা তেমন শিক্ষিত নন, জার্মান ভাষায় কথা বার্তা বলতে পারেন না, তারাই এই ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন৷
পরিষ্কারের বাতিক
সারার মাকে গত ৪০ বছরে ধোয়াধুয়ির একটা বাতিক পেয়ে বসে৷ সবকিছু বারবার সাফ সুতরা করা চাই৷ জুতায় হাত লাগলে সাথে সাথে হাত ধোয়ার একটা চাপ আসে মাথায়৷ বারবার হাত ধুতে ধুতে ত্বক শুকনা ও রক্তাক্ত হয়ে গেছে৷ মেয়ে সারা মনে করে, ‘নোংরা বিদেশি’ এই কথাটা শুনতে শুনতে মায়ের পরিষ্কার হওয়ার ঝোঁকটা বেড়ে গেছে৷
বর্ণবৈষম্যের নানা রূপ
বর্ণবিষম্য ও বিদেশি বিদ্বেষ সারার পরিবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ বাড়ির কাছাকাছি নব্য নাৎসিরা সমবেত হয় বছরে একবার৷ তাদের হম্বিতম্বির সময় বাড়ি থেকে বের হতেই ভরসা পায়না পরিবারের কেউ৷ দৈনন্দিন জীবনে বিদেশি বিদ্বেষের প্রকাশভঙ্গিটা অনেকটা সুপ্ত৷ যা বোঝা যায় স্কুল কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে৷ ছোট বেলার বহু স্মৃতি আজো কষ্ট দেয় সারাকে৷ প্রাইমারি স্কুলে ব্যাকরণ ভুল করলে শিক্ষিকা সবার সামনে অপমান করেছেন তাকে৷
স্কুলের এক এক্সারশনেও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সারার৷ রাতের খাবারে সুপের সাথে শুয়োর মাংসের সসেজ থাকায় কিছুই খেতে পারেনি মেয়েটি৷ খিদে নিয়েই বিছানায় যেতে হয় তাকে৷ সমস্ত ক্লাসে সারাই ছিল একমাত্র মুসলমান ছাত্রী৷ তার যে শুয়োরের মাংস খাওয়া বারণ, এ কথাটা কেউ মনে রাখেনি৷ নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সে৷
পরিচিতির অন্বেষণে
নিজের পরিচিতি নিয়েও একটা দোটানা রয়েছে সারার৷ জার্মানিতে মরোক্কান, আবার মরক্কোতে বেড়াতে গেলে জার্মান মনে করা হয় তাকে৷
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও এই দোটানা থেকে মুক্ত হতে পারেনি সারা৷ একদিকে জার্মান সমাজের আর দশটা মেয়ের মতই এক আধুনিক তরুণী সে৷ অন্যদিকে শেকড়ের টান, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব৷ এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা বেশ কষ্টকর৷ বিশেষ করে সপ্তাহান্তে যখন সহপাঠিনীরা পার্টি বা ডিসকোথেকে যায়, তখন মন খারাপ হয়ে যায় তার৷ অনেক সময় তাদের সঙ্গে আনন্দ উত্সবে গা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করে৷ মাঝে মাঝে যোগও দেয় তাদের সঙ্গে৷ কিন্তু তারপরই বিবেকের দংশন পেয়ে বসে তাকে৷ সেই সাথে আতঙ্কও থাকে মনে, অন্য মরক্কানরা যদি দেখে ফেলে? এইভাবে দুই সংস্কৃতির টানাপড়েন, অশান্তি ও আতঙ্কে ভুগতে থাকে সারা৷
প্রয়োজন থেরাপি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসীদের মধ্যে এই ধরনের মানসিক অসুস্থতা খুব বিরল ঘটনা নয়৷ রোগটা কতদূর গেড়ে বসেছে তার ওপর নির্ভর করে চিকিত্সা বা থেরাপি৷
রোগের লক্ষণগুলি ওষুধ দিয়ে ভাল করা যায়, কিন্তু আসল অসুখটা ভাল করতে হলে থেরাপি প্রয়োজন৷ সারাও থেরাপি নিচ্ছে৷ চেষ্টা করছে তার দুই ‘আমির’ মধ্যে দূরত্বটা কমিয়ে আনতে৷ সারার জানায়, ‘‘আমার পরিবার ও বন্ধবান্ধুবের অনেকেই এই ধরনের টানাপড়েনে কোনো একটি দিককে বেছে নেয়৷ আর সেটাই আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি না যে, আমি একজন জার্মান বা একজন মরোক্কান মেয়ে৷ আমি যে দুটোই, এটাই আমাকে মেনে নিতে হবে৷ সে পর্যন্ত যেতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে৷”