অটিস্টিক শিশুর সাথে ভাই-বোনের সম্পর্ক

অটিজম সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই এখন জানি। তাই আজ একজন অটিস্টিক শিশুর ভাই/বোনের জন্য লিখতে চাই। একটি অটিস্টিক শিশুর ভাইবোন হতে পারা যেমন আশীর্বাদ তেমনি চ্যালেঞ্জিংও বটে। শিশুর বিকাশের সাথে সাথে তারা যদি অটিজম সম্পর্কে জানে, তাহলে অটিস্টিক ভাই/বোনদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হতে পারে। একটি সময় পর তার ভাই/বোনই তার কেয়ারগিভার হয়ে তার প্রতিভা বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু কিছু বাবা-মা অভিযোগ করেন, একি সাথে কাছাকাছি বয়সের দুটি বাচ্চাকে বড় করা কষ্টকর। তার মধ্যে যদি একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু হয় তাহলে সর্বক্ষণ তার পরিচর্যা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কোনো বাবা-মা বলেন যে, অটিস্টিক শিশুটি না বুঝে ছোট ভাই/বোনকে আঘাত করে, ধাক্কা দেয়, খেলনা ভেঙে দেয়, কামড় দেয় ইত্যাদি আচরণ করে যা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা শিশুটির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আবার কেউ বলেন, স্বাভাবিক শিশুটি তার অটিস্টিক ভাই/বোনের আচরণকে অনুকরণ করে যা তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এই ভয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানদের আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। যেমন, দাদার বাড়ি কিম্বা নানার বাড়ীতে রাখা হয়। অনেক সময় একই বাড়িতে থেকেও একদম আলাদা করে দেয়া হয় যেনো ভাই/বোনে দেখা না হয়। বেড়ে উঠার সাথে সাথে কোনো কোনো বাবা-মা স্বাভাবিক ছোট সন্তানকে বড় সন্তান আর বড় সন্তানটি অটিস্টিক হওয়ায় তাকে ছোট বলে পরিচয় দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সত্যিকার অর্থে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর মায়ের প্রতিদিনের এই জার্নিটা কতটা আনন্দের কিম্বা কষ্টের তা শুধু তিনিই জানেন। তাই উপদেশ নয় আমরা শুধু আলোচনা করে জেনে নিতে পারি যে একজন অটিস্টিক শিশুর ভাই/বোনের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে আমরা কি কি পদক্ষেপ নিতে পারি।

১। শিশুর নিরাপত্তা: অবশ্যই উভয় শিশুর অবস্থানের সময় কোনা ধারালো খেলনা, ছুরি, কাঁচি, ব্লেড, এন্টি কাটার, ভংগুর আসবাবপত্র যেমন: কাচ, সিরামিক জাতিয় কিছু যেন না থাকে। যদি উঁচুতলা ফ্ল্যাটে থাকেন অবশ্যই জানালা, বারান্দায় নেট ব্যাবহার করবেন। ইলেক্ট্রিক তার, সুইচ নিরাপদ স্থানে রাখবেন যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা এড়ানো যায়।

২। অটিজম ব্যাখ্যা করা: কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নয় বরং সহজ, সাবলীল ভাষায় বলুন, “আমাদের পরিবারটি একটু অন্যরকম কারণ আমাদের ভাই/বোন একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আর তাই আমরা অন্যান্য পরিবারের চেয়ে ভিন্ন ভাবে শিখব এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীল হব”। ছোট বাচ্চারা মনে করতে পারে অটিজম এমন একটি জিনিস যা সর্দি-কাশির মতো। একজনের থেকে আর একজনের হয়। অথবা কেউ কেউ মনে করতে পারে যে খারাপ আচরণ বা খারাপ চিন্তার মাধ্যমে ভাই/বোনের অটিজম হয়েছে। শিশুর মাঝে যেনো কোনো রকম ভ্রান্ত ধারনা তৈরি না হয় এবং স্কুল থেকে সে তার ভাই/বোনকে নিয়ে বুলির শিকার হয়ে হীনমন্যতায় না ভুগে। যেনো তা হ্যান্ডেল করতে পারে তাই তাকে আগে থেকেই অটিজম সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ করে দিন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বলতে পারেন, ‘অটিজমের কারণে মানুষ তোমার থেকে একটু আলাদাভাবে চিন্তা করে। কিছু অটিস্টিক শিশু হয়তো অন্যভাবে খেলতে বা কথা বলতে পারে যা অন্য শিশুদের জন্য অনুভব করা একটু কঠিন। তোমার ভাই/বোন এখনও এই কাজটি করতে শেখেনি তাই সে অন্যভাবে করে’।

৩। বাচ্চাদের জন্য বিশেষ সময় বের করা: চেষ্টা করুন আলাদা সময় বের করে উভয়কে একসাথে নিয়ে মজা করতে। যেমন: রঙ দিয়ে খেলা, ছবি আঁকা, সম্ভব হলে কাছের মাঠে দৌড় ঝাপ করতে যাওয়া। এক সাথে বাসায় মুভি দেখার আয়োজন করা ইত্যাদি। পারিবারিক নিয়ম ও দায়িত্ব ঠিক করুন এবং নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখুন। আপনার সাধারণ বিকাশমান শিশুর জন্য প্রতিদিন নিয়মিত সময় নির্ধারণ করুন। ঘুমানোর সময় গল্পের বই পরে ঘুম পারানো, দিনের শেষে অন্তত ১০ মিনিট একসাথে বসে কিছু মজার খেলা করুন। জড়িয়ে ধরুন, ভাই/বোনের যত্ন করছে জেনে প্রশংসা করুন। সপ্তাহে একটি দিন অটিস্টিক শিশুর দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বস্ত পরিচর্যাকারী রাখুন যাতে আপনার সাধারণ বিকাশমান শিশুর সাথে সময় কাটাতে পারেন।

৪। খেলনা শেয়ার করা: বেশিরভাগ ভাইবোনের মাঝে একটি সমস্যা হল খেলনা শেয়ার না করা। আমরা যতই ভাবি যে এটি একটি দুর্দান্ত ব্যাপার। কিন্তু ভাইবোনের এমনও সময় থাকে যখন তারা দ্বিমত পোষণ করে, মারামারি করে, একে অপরকে ঘৃনা করে এবং বাবা-মার মনোযোগের জন্য অস্থির থাকে। কিন্তু এরকম সময় আপনি নিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর থাকতে পারেন যে খেলনাটি শেয়ার করেই খেলতে হবে, এটা কারো একার নয়।

৫। স্বাভাবিক শিশুর আবেগকে বোঝা: বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর ভাই/বোনরা প্রায়শই বিশেষভাবে যত্নশীল, সহানুভূতিশীল, স্বাধীন, সহনশীল এবং অন্যদের প্রয়োজনের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়। এটি তাদের একটি বিশেষ গুণ বলা যেতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও অটিস্টিক শিশুর ভাই/বোনরা তাদের অটিস্টিক ভাই/বোনের আচরণ বা পারিবারিক জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে দুঃখ, রাগ, উদ্বিগ্ন বা বিভ্রান্ত বোধ করে। কেননা বেড়াতে যাবার সময় হয়তো বা তারা পুরো পরিবার একসাথে যেতে পারে না। তার ভাই/বোন সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে বিব্রত বোধ করে। পরিবারের বাইরে যাওয়ার সময় লোকেদের তাকানো বা অবাঞ্ছিত মনোযোগে দ্বারা বিব্রত হয়। আবার মনে হতে পারে বাবা-মা তাকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে, ভালোবাসছে না এ থেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে পারে।

৬। আচরণ সম্পর্কে কথা বলা: যত তাড়াতাড়ি আপনার সাধারণ বিকাশমান শিশু বুঝতে পারে, যে তাদের ভাই/বোন অন্য শিশুদের থেকে আলাদা আচরণ করছে ততো ভালো। বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে সাথে আরও জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে এবং আরও তথ্যের প্রয়োজন হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার সন্তান বলে, ‘আমি বাবুর সাথে খেলতে পছন্দ করিনা কারণ সে আমার খেলনা কেড়ে নেয়।’ আপনি বলতে পারেন, ‘এটি অবশ্যই হতাশাজনক’। বাচ্চাদের সাথে তাদের অনুভূতি নিয়ে নন জাজমেন্টাল উপায়ে কথা বলুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বলতে পারেন, “আমাকে বলো কি হয়েছে এবং তোমার কেমন অনুভূতি হচ্ছে।” আপনার সাধারণ বিকাশমান বাচ্চার বুঝতে সাহায্য করার জন্য আপনার নিজের অনুভূতিগুলো শেয়ার করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বলতে পারেন যে আপনিও কখনও কখনও হতাশ বোধ করেন।

৭। পরিবারের বাইরে একটি কমিউনিটিতে যোগদান যাদের অটিস্টিক শিশু আছে: পরিবারে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আছে এটা বাবা-মা মেনে নিলেও অনেক সময় আত্মীয় স্বজনরা মেনে নিতে পারেন না। যা নিয়ে স্বামি-স্ত্রীর জীবনেও অশান্তি হয় যার প্রভাব আপনার সন্তানের উপর পরে। বাবা-মার আলাদা হয়ে যাবার ভয় তৈরি হতে পারে তার মাঝে। তাই আপনি যখন এরকম একটি সামাজিক গ্রুপের সাথে সংযুক্ত থাকবেন, পরিবারের বাইরের বন্ধুত্ব আপনার সন্তানকে অনুভব করতে সাহায্য করতে পারে যে সেই কেবল একটি অটিস্টিক শিশুর ভাই/বোন নয়। তার ভাই/বোনের প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পেতে সহায়তা হবে যা উভয় শিশুর মেধা বিকাশকে তরান্তিত করবে, বৃদ্ধি পাবে সামাজিক যোগাযোগ।

একজন অটিস্টিক শিশুর ভাই/বোনের সম্পর্ক যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে গড়ে উঠলে তা পুরো পরিবার এবং সমাজকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে কাউন্সেলিংও নেয়া একটি ভাল উপায় হতে পারে, যদি বাচ্চাদের এ সময়টা মোকাবেলা করতে অসুবিধা হয়।

-ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
মনোবিজ্ঞানী, “শৈশবকালীন প্রতিকূলতা ও নিউরো ইমেজিং স্টাডি বাংলাদেশ”, আইসিডিডিআর, বি। মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইডার। আজীবন সদস্য- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি। প্রতীষ্ঠাতা- সোনারতরী শিশু কিশোর সংঘ

Previous articleঅতিরিক্ত শপিং একটা মানসিক রোগ
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য চর্চার মাধ্যমে বিবেকবান মানুষ হতে হবে

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here